শেষ বাঁশি পর্যন্ত, শুধুই রিয়াল মাদ্রিদ!

ম্যাচের পরপরই আমি সবার জন্য পাঠযোগ্য কিছু লিখতে পারি না। রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচ মানে আবেগের উথাল পাথাল এক খেলা। হতাশাগুলি যেমন সমর্থক হিসাবে শেলের মত বুকে বিধবে, সেরকম জয়ের আনন্দ এতটাই উদ্বেলিত করবে আপনাকে যে আপনি হয়তো হাসবেন, কিন্তু আপনার গাল বেয়ে দুই চারফোঁটা চোখের পানিও গড়িয়ে পড়বে। এই অবস্থায় ফুটবল নিয়ে বিশ্লেষনী আলাপ লেখা যায় না।

আজ যখন গতকালকের ম্যাচ নিয়ে ভাবতে বসেছি, প্রথমেই মনে হচ্ছে- কী অসাধারণ ফুটবল দ্বৈরথটাই না আমরা দেখলাম। নির্মানাধীন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ভগ্ন দশা যেমন ঢেকে ঢুকে আমরা ইউরোপের সবচেয়ে দামী স্কোয়াডগুলির একটিকে আতিথেয়তা দিয়েছি, সেরকম গত লেগের ০-১ স্কোরলাইন ও ঢেকে রেখেছিল আসলে আমরা কতটা ছন্নছাড়া ফুটবল খেলেছিলাম প্রথম লেগ জুড়ে। কিন্তু ইউরোপিয়ান ফুটবলের রাত, চ্যাম্পিয়ন্স লীগের লা চ্যাম্পিয়ন্স এর সুর আর করিম মোস্তফা বেনজেমার এই উপলক্ষ্যে আরো একবার নিজেকে বড় করে তোলা- এই মূহুর্তে এসবের ফলাফলে মূর্ত সত্য হচ্ছে, রিয়াল মাদ্রিদ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ৪৫ মিনিট ভাল খেলেই উৎরে গেছে তাদের এসিড টেস্ট। অসম্পূর্ণ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে কোয়ার্টার ফাইনালের দাবী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের অন্যতম দাবীদার হয়ে, চ্যাম্পিয়ন হবার মত দল গড়া এক পরাশক্তিকে দলিত করে, পদানত করে।

একটা ফুটবল ম্যাচ দুই অর্ধের এবং দুই অর্ধের গল্প সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। রিয়াল মাদ্রিদ এ ধরনের কাজ আগে অনেকবার করে দেখিয়েছে। প্রথম ৪৫ মিনিটে রিয়াল মাদ্রিদ গত লেগের মত ছন্নছাড়া না হলেও দুই দলের মধ্যে শ্রেয়তর দলের নাম হিসাবে কোন পাঁড় ভক্তও রিয়াল মাদ্রিদের হয়তো নেবেন না। রিয়াল বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করেছে এবং সেগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। বেনজেমা-ভিনিসিয়াস-আলাবা প্রতিপক্ষের অর্ধে ভাল কাজ দেখালেও কাউন্টারে এবং প্রেসের বিপরীতে মিলিতাও-নাচোরা বেশ ক’বার ই খেই হারিয়েছেন। এর দায় প্রায় পুরোটাই কিলিয়ান এম্বাপ্পের। পি এস জি এম্বাপ্পের ইনজুরী নিয়ে অত্যন্ত নিম্ন রুচির একটা মনস্তাত্বিক খেলা খেলতে চেষ্টা করেছে। সেটাতে অবশ্যই তাঁর ও সায় ছিল। কিন্তু হেরে যাওয়া এই ম্যাচেও কিলিয়ান এম্বাপ্পেকে নিয়ে কিছু শব্দ বরাদ্দ রাখতেই হবে। এক কথায় কী অসাধারণ খেলোয়াড় তিনি হয়ে উঠছেন, এটা তার বয়স বিবেচনায় নিলে এত বছর পরও এখনো অবিশ্বাস্য। মেসি-রোনালদোর মত সংখ্যাতাত্বিক আলাপে তিনি যদি পিছিয়েও থাকেন, বড় ম্যাচে, বড় ভেন্যুতে, বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তাঁর যে দুর্দমনীয় দাপট এটাই তাকে সম্ভাব্য বিশ্বসেরা থেকে সন্দেহাতীত বিশ্বসেরার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। প্রথমার্ধেই বেশ কবার কর্তোয়া তাকে ফিরিয়েছেন। একটি গোল অফসাইডে বাতিল হবার সাড়ে তিন মিনিটের মাথায় তিনি গোল করেছেন সেটাও প্রায় একক প্রচেষ্টায় দুইজন ডিফেন্ডার এবং তর্কযোগ্য ভাবে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গোলকীপারের বাধা ভেদ করে। রিয়াল মাদ্রিদের জন্য কিলিয়ান এম্বাপ্পেকে দলে ভেড়ানো এখন প্রায় একটা দায়, একটা কর্তব্য। এর চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন কোন খেলোয়াড় সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে দিতে পারতেন না।

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে দেয়া বিজ্ঞাপনের ব্যাপার যেহেতু আসছেই, এটাও বলে দেই যে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর নিজের বিজ্ঞাপনগুলিই এই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের হাইলাইটস। আপনি যদি ইউরোপিয়ান ফুটবলের খবরের জন্য ইংরেজ, ফরাসী কিংবা বাংলাদেশী মূলধারার মিডিয়া অনুসরণ করেন, প্রথমার্ধে পি এস জি এর কিছুটা এগিয়ে থাকা নিয়ে যত বীরত্বগাথা দেখেছেন, তার অর্ধেক ও পাবেন না দ্বিতীয়ার্ধে রিয়াল মাদ্রিদের পোড় খাওয়া সৈনিকেরা কীভাবে একদল তরূণ খেলোয়াড়দের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ম্যাচ বের করে এনেছেন তা নিয়ে। 

11 crazy stats from Real Madrid's stunning remontada against PSG

রিয়াল মাদ্রিদ আইকনদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন একদল তরুণ। ভবিষ্যতের রিয়াল মাদ্রিদের হাল ধরবেন তো এরাই? (ছবিঃ প্লানেট ফুটবল/ Planet Football থেকে সংগৃহীত)

করিম বেনজেমা গতকাল ছিলেন সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের ই সেরা টাচে। ২০১৫ সালে মালমোর বিপক্ষে ৮-০ তে জেতা ম্যাচের পর চ্যাম্পিয়ন্স লীগে নিজের তৃতীয় হ্যাটট্রিক পেয়েছেন। ৩৪ বছর ৮০ দিন বয়সে এটা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড। একই দিনে রিয়ালের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ছাড়িয়ে গেছেন ডি স্তেফানোকেও। এসবই  পরিসংখ্যানের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যেটা লেখা থাকবেনা, প্রথমার্ধ থেকেই প্রতিপক্ষের গোলকীপারকেও প্রেস করছিলেন তিনি। সেটার ই ধারাবাহিকতায় দোনারুমার খেই হারানোতে রিয়াল ম্যাচে ফিরেছিল। লেখা থাকবেনা কীভাবে কয়েক ইঞ্চির জন্য আরো একটি গোল পাননি। লেখা থাকবেনা অধিনায়ক বনাম অধিনায়ক লড়াই এ মার্কুইনহোসকে পুরো দ্বিতীয়ার্ধ ধরে কী পরিমাণ মানসিক চাপে রেখেছিলেন তিনি বক্সে প্রতিটি মুভমেন্টে। আর যেটার ব্যখ্যা আমি নিশ্চিত কোথা থাকবেনা- কীভাবে প্রতিপক্ষের ছেড়ে দেয়া প্রায় গড়িয়ে আসা বলকে পুরোদস্তুর এসিস্টের মত করে আশা করে বসে থেকে রিয়াল মাদ্রিদের তিন নাম্বার গোলটা তিনি করেছেন। যারা বেনজেমাকে সাড়ে নয় কিংবা স্ট্রাইকারের ছদ্মবেশে প্লেমেকার বলতেন, এই গোলগুলি তাদেরকে একটা বার্তাই। চাইলে বেনজেমা যে কারো চেয়ে ভাল বক্স কেন্দ্রিক ফরোয়ার্ড ও হতে পারতেন। 

আপনাকে এই ম্যাচের কথা বলতে গেলে বলতে হবে লুকা মদ্রিদের কথা, যিনি ৩৬ বছর বয়সে নিজেদের বক্স থেকে বল বয়ে এনে গোল তৈরি করেন। যিনি প্রতিপক্ষের সামনে নিজের বক্সের সুরক্ষা দেন এবং প্রতিটি পাসে, প্রতিটি মুভমেন্টে গ্রেটনেসের শর্তগুলি মনে করিয়ে দেন। আপনাকে বলতে হবে ফেদে ভালভার্দে, কামাভিঙ্গা এবং ভিনিসিয়াস জুনিয়রদের মত তরুণদের কথাও। যারা বন্ধ হয়ে যাওয়া অন্ধকার ম্যাচে অগ্রজরা যখন মশাল জ্বালিয়েছেন সেটা বয়ে নিয়ে যাবার সাহস আর আশা দেখিয়েছেন। কিংবা ডেভিড আলাবা আর থিবো কর্তোয়ার মত নিয়মিত পারফর্মারদের কথাও যারা সব সময় ই এতটা ভাল খেলেন যে খারাপ না খেলা অব্দি সেটা চোখে পড়েনা।

চ্যাম্পিয়ন্স লীগে রূপকথার রাত রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এটাই প্রথম নয়। দলের ১২০ বছরের ইতিহাসে এমন অগণিত রাতই রিয়াল মাদ্রিদকে ইউরোপের সেরা দল বানিয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি আর মাঠ যে মোহ, যে ভাবাবেগ, যে রোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার অনূভূতি দেয় তার জন্ম দিয়েছে। তাই রাউন্ড অব ১৬ এর এ ম্যাচ জিতে খুশী বা হল্লা করার আগে মনে রাখতে হবে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য সফল ক্যাম্পেইন সেটাই, যেটার শেষে দলের অধিনায়ক শিরোপা উচিয়ে ধরেন। তাই আমদের যাত্রা এখনো বহুদূরের পথে।

এই ম্যাচেও আসেন্সিও এবং কার্ভাহালের বিবর্ণ থাকা নিয়ে আনচেলত্তিকে ভাবতে হবে। কামাভিঙ্গা এবং ফেদে ভালভার্দে মৌসুমের চেহারা বদলে দেয়া ম্যাচ খেলে ফেলার পর নিজেদের নিয়েও আরো একটু ভাবতে বলতে পারেন আঞ্চেলত্তিকে। সর্বোপরি, কার্লো আনচেলত্তিকেও বুঝতে হবে তার জন্য এই মূহুর্তে কোন খেলোয়াড়েরা সর্বোচ্চ দিতে পারছেন। 

কোপা ডেল রে তেও এডেন হ্যাজার্ড এবং ইস্কো রিয়ালের হয়ে কঠিন ম্যাচ বের করে এনেছিলেন। যদিও পরের রাউন্ডেই আমাদের জয়যাত্রা থেমে যায়। বড় বা কঠিন জয়ের সবচেয়ে বড় সুফল তখনই পাবেন যখন সেই জয় আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে। সেই জয়ের এড্রেনালিন রাশ আপনাকে এগিয়ে দেবে শিরোপা পর্যন্ত। এই জয় মৌসুমের অন্যতম সেরা পারফরমেন্স এ নিয়ে তর্কের কোন সুযোগ নেই। মাসলে সমস্যা নিয়ে বর্ষীয়ান খেলোয়াড়েরা যেভাবে দলের জন্য পরিশ্রম করে চলেছেন সেটা যেমন দলকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে তেমনি সোসিয়েদাদের জালে চার গোল দেয়ার পর পি এস জিকে হারিয়ে দেয়া হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে ফেব্রুয়ারীর দুঃস্বপ্ন পার হয়ে মার্চে আনচেলত্তির দল আবার জাগবে স্বরূপে।

শেষ করি ইউরোপিয়ান ফুটবলের বর্তমান হালচাল নিয়ে কথা বলে। গতকালকের ম্যাচের পর নাসের আল খেলাইফির রাগ, মাউরিসিও পচেত্তিনোর অনুযোগ কিংবা VAR দিয়ে দোনারুমার ফাউল যাচাই নিয়ে সংবাদ পড়ে ফেলারই কথা সবার। একটি দলের নিয়ন্ত্রণ যখন একটি রাষ্ট্রের হাতে, তাদের যখন আবার নিজেদের মিডিয়া আছে, আছে ফ্রান্স ফুটবলের বা ফরাসী রাজনীতির দন্ডমুন্ডের কর্তাদের সমর্থন- তখন এই খেলাটা আর শুধু মাঠে থাকেনা। রিয়াল মাদ্রিদ প্রতিদিন মাঠে নামে নিজেদের সাফল্যের আসামী হয়ে। নিজেদের লীগের অনুষদ তাদের বাজে স্পন্সরশীপ সমর্থন না করায় রিয়াল মাদ্রিদকে দোষ দেয়। অন্যরা তো বটেই, কিছু মনঃপুত না হলেও মাদ্রিদ ঘেষা মিডিয়াও ছেড়ে কথা বলেনা। আর রাজনৈতিক দিক থেকে কিছু না করতেই রাজধানী শহরের এলিটিস্টদের ক্লাব বলে রিয়াল মাদ্রিদ কারণ না জেনেই অনেকের ভিলেন। তাই মাঠে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের নন রেভিনিউ অর্থের বিপক্ষে পারফরমেন্স দিয়ে এরকম জয়ের স্বস্তিও তাই মাঠের বাইরে চলে আসে। যদি রিয়াল মাদ্রিদ কিলিয়ান এম্বাপ্পেকে সত্যিই নিজেদের করে নিতে পারে (এবং বিনামূল্যে) তাহলেই এই জয়ের পূর্ণ রূপ দেখা যাবে। তবে ফুটবল বনাম রাষ্ট্রের লড়াই এ এবার ও ফুটবল দিয়ে আমরা যে একট রাষ্ট্রায়ত্ব ক্লাবকে হারিয়ে দিয়েছি, সেটার বীরত্বগাথা না হয় থাকুক আপাতত সবার মন জুড়ে। ১৮০ মিনিটের লড়াই শেষ হয়েছে, মাঠের বাইরের লড়াই হয়তো চলবে দীর্ঘদিন। কিন্তু মাঠ হোক বা বাইরে হোক, শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত, শুধুই রিয়াল মাদ্রিদ!

_________________________________________

 

আসিফ হাসান জিসান

১০ ই মার্চ ২০২২
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক

ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

(PS: cover image materials downloaded from the Internet or image rights belong to original owners)

You May Also Like