ক্লাব আমেরিকার সাথে রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচটা দেখে থাকলে আপনার মনে দু’টো অনূভূতি থেকে যাবার কথা। প্রথমত, রিয়াল মাদ্রিদ এখনো দু’টি প্রীতি ম্যাচ খেলে একটিও জয়ের দেখা পায় নি এটা নিয়ে একটু মনে খচখচানি। আর অন্যটা করিম বেনজেমার গোল!
বক্সের বাইরে আসেন্সিওর সঙ্গে খুব নীরিহ ধরনের একটা ওয়ান টু করে আগাচ্ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রাণভোমরা। এরপর হুট করেই শট। বিশ্বকাপের পর দুনিয়াজোড়া নাম ছড়িয়ে পড়া গুইলিরিমে ওকোচার জন্য এই গোল খেয়ে বসাতে কোন ব্যর্থতা নেই। এই শট দুনিয়ার কোন গোলকীপারের ই থামানোর সামর্থ্য নেই। কোনদিন ছিল ও না। করিম মোস্তফা বেনজেমা যেন শুরু করলেন ঠিক সেখান থেকে যেখানে নিজেকে রেখে গত মৌসুম শেষ করেছিলেন। সেই জায়গার নাম- দুনিয়াজোড়া ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব।
@fede98000 Karim Benzema goal vs club America 😍😍 #fede980 ♬ sonido original – FBG
বিশ্বের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় কে? এই প্রশ্নের উত্তরে তথ্য, উপাত্ত, বিচার কিংবা বিশ্লেষনের একটা ভূমিকা আছে অবশ্যই। করিম বেনজেমার পক্ষে আপনি বলতে পারবেন এই নিরিখে অনেক কিছুই। লা লীগার সর্বোচ্চ গোলদাতা, চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, দুই টুর্নামেন্টের ই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু করিম বেনজেমাকে সময়ের শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে তার উপস্থিতির ভূমিকাটাই।
বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় তার মুন্সিয়ানা দেখাতে ৯০ মিনিট জুড়েই ভাল খেলেন এমনটা নয়। ২০১২-১৩ সালের লিওনেল মেসির কথা ভাবুন। ওই সময়ের ম্যাচগুলো ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। মেসি গোল করবেন ই। কিংবা ভাবুন ২০১৬-১৭ সালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথাই। এটলেটিকো মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাস- যে আসছে সামনে রোনালদোর সামনে অসহায় তাদের ডিফেন্স। তুলোধুনো হচ্ছে সবাই। এই খেলোয়াড়দের চলনে, নড়নে চড়নে ঠিকরে বের হত শ্রেষ্ঠত্ব। এবার করিম বেনজেমার দিকে তাকান। এই গত মৌসুমেই তো পি এস জি, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে জুজু হয়ে এসে ভয় দেখিয়েছেন সবাইকে। সেই ভয় বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এ যেন অবশ্যম্ভাবী এক বিপর্যয়। আপনার দল যদি রিয়াল মাদ্রিদের সামনে পড়েই যায়, করিম বেনজেমা নামের এই বিপর্যয় আপনার কপালে জুটবেই। আর যদি ভয় পেয়ে তাকে বাধা দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বসেন? তাহলে ভিনিশিয়াস জুনিয়র নামে তার ভাবশিষ্য আপনাকে ভুগিয়ে মারবেন।
আধুনিক স্ট্রাইকারদের জন্য বেনজেমার প্রতিটি মুভমেন্ট ই হতে পারে এখন গবেষনা আর শিক্ষার উপকরণ (ছবিঃ Premier Sports)
বেনজেমার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটে এমনিই পালকের অভাব নেই। এই ধরুন খুব সহজেই তর্ক বাধিয়ে দেয়া যায় যে রোনালদো যে দল নিয়ে ইউরোপ জয় করেছিলেন, বেনজেমা তার ইউরোপ জয়ের পথে সে দলের বুড়িয়ে যাওয়া ছায়ায় ঢাকা একটা সংস্করণের বেশি কিছু পান নি। কিন্তু ১৬ গোল করা এবং ট্রফি উচিয়ে ধরায় রোনালদোর চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন কি কোথাও? একদমই না। রোনালদোকে বলা যায় আধুনিক ফুটবলের নতুন যুগের প্রোটোটাইপ। ইতিহাসের সেরা হাইব্রিড উইঙ্গার। হাইব্রিড উইঙ্গার কিংবা ফলস নাইনদের জ্বালাতনে আধুনিক যুগে ক্লাসিক নাম্বার ৯ হারিয়ে যাচ্ছে বলে যখন হাহাকার, বেনজেমা সেখানে আধুনিক নাম্বার ৯ দের জন্য একদম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া বিজ্ঞাপন। তিনি রোনালদোর জন্য প্লেমেকার ছিলেন। ছিলেন ফলস নাইন। এসব করতে গিয়ে ফিনিশিং এ ধার হারিয়ে সমালোচনাও কম শোনেননি। বয়স ৩০ হয়ে গেছে, এরপরে কি কেউ বদলায়? বেনজেমা বদলান নি। রোনালদো চলে যাবার পর নিজের ওপর অর্পিত খোলসটা ঝেড়ে ফেলেছেন। অলিম্পিক লিওনের সেই দুরন্ত প্রতিভাকে নিয়ে এসেছেন লাইমলাইটে। কি নেই সেই খেলোয়াড়ের মধ্যে? গতি, ড্রিবলিং, পাওয়ার, স্কিল তো আছেই। সেই কেক এর ওপরে চেরি হয়ে আছে প্রায় অপার্থিব ফার্স্ট টাচ। এতটাই মোলায়েম সেই টাচ যে সেটার অলসতা আপনাকে ধোঁকা দিয়ে বসবে!
২০০৯ সালে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ নিজে গিয়েছিলেন করিম বেনজেমার বাড়িতে। তাকে তিনি দলে ভিড়িয়েছিলেন নিজের, জিনেদিন জিদানের আর রিয়াল মাদ্রিদের গ্ল্যামারের সর্বোচ্চ ঝলক দেখিয়ে। বলেছিলেন বেনজেমার মধ্যে রোনালদো নাজারিও আর জিনেদিন জিদানের খেলোয়াড়ি সত্ত্বার মিলন দেখেন। এটা নিয়ে হাসিঠাট্টা কম হয়নি। কিন্তু বেনজেমার অলস টাচে যদি জিদানের স্নেহধন্যতার পরিচয় পান, গতকালকের এই গোলটার মধ্যে কি রোনালদো নাজারিওর মত জেনে বুঝে ধ্বংসের আবাহন একটুও দেখেন না?
এই তুলনায় এখন আর হালকা রসিকতার ছোঁয়া নেই। বরং বেনজেমাই এখন জোরগলায় বলতে পারেন নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী (ছবিঃ Real Madrid Website)
৩৪ বছর বয়সী বেনজেমা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শুরু করতে যাচ্ছেন তার ১৪তম মৌসুম। গোল সংখ্যায় রাউলকে ছুয়ে ফেলেছেন। সামনে শুধুই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেটা যদি কোনদিন ধরা নাও হয়, এসিস্ট সংখ্যায় বেনজেমার সামনে যে কেউ নেই, শুধু এটাই রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে অমর আর অক্ষয় করে রাখতে পারত বেনজেমাকে। বেনজেমা যদি সুস্থ থাকেন তাহলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে মাঠে নামার বিচারে এই মৌসুমেই সান্তিলানা আর সামনের মৌসুমে সার্জিও রামোসকেও ছাড়িয়ে যাবেন তিনি হেসে খেলেই। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সর্বোচ্চ উয়েফা সুপারকাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপে নামা, বিদেশি খেলোয়াড় হিসাবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা এই ধরনের রেকর্ডে বেনজেমা তো আছেন ই, সাথে বলে রাখা ভালো রাউল, সান্তিলানা, হেন্তো, পিরি বা বুয়েত্রাগানোর চেয়ে গোল করার নিয়মিত মুখ হিসাবে বেনজেমা কিন্তু অনেক খানি আগানো।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলে ব্যালন ডি অর জেতা খেলোয়াড় আছেন ৭ জন। সব মিলে সাদা জার্সিধারী কেউ ব্যালন ডি অর জিতেছেন ১১ বার। ব্যালন ডি অর জেতা এবং রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলা খেলোয়াড় আছেন ১০ জন। এখন শুধু অক্টোবর মাসের অপেক্ষা যেখানে করিম বেনজেমা ঢুকে যাবেন এই অমরত্বের ডাক শুনতে পাওয়াদের তালিকাতেও। এই যে এত এত এওয়ার্ড, পুরষ্কার আর আলোচনা, সব ছাপিয়ে করিম বেনজেমা কেন কিংবদন্তী হয়ে থাকবেন জানেন?
করিম বেনজেমা প্রমাণ করেছেন- এভাবেও মন জয় করা যায়। এভাবেও ফিরে আসা যায়।
করিম মোস্তফা বেনজেমা- রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তী।
_____________________________
আসিফ হাসান জিসান।
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক।
ঢাকা, বাংলাদেশ