দাবায় রাখতে পারবে না!

১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফুটবলের নিয়মকানুন প্রথম লেখার কাজটা শুরু হয়। সেটা ফুটবল এসোসিয়েশান বা FA এর বর্তমান স্বীকৃত নিয়মে আসতে আসতে সালটা হয়ে যায় ১৮৬৩। দীর্ঘ সময় লাগলেও আজ থেকে সেটা প্রায় ১৫৯ বছর আগের কথা। এর মধ্যে গোল্ডেন গোল সিলভার গোল, এওয়ে গোল টাইপের কিছু নিয়ম টুর্নামেন্ট ভেদে এদিক সেদিক হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে জার্সি নাম্বার বা দেখনদারিতেও। কিন্তু খেলার নিয়ম রয়ে গেছে একই। ফুটবল মানেই দুই পায়ের পেছনে আপনার মাথার জাদুকরি সব মুহুর্ত। আপনি মাথায় যা ভাববেন, যতটা সৃষ্টিশীল হবেন, সেটা যদি পায়ে অনুদিত করতে পারেন তবেই আপনি দুর্দান্ত ফুটবলার। ফুটবল খেলার বয়স দিনে দিনে অনেকদিন হয়ে গেলেও এই দর্শন চিরায়ত। এইট বদলায় নি। ফেলে দেয়া হয় নি। এই আনন্দের জন্যই মানুষ খেলা দেখে, এই আনন্দের খোঁজে মানুষ ছুটে যায়, জীবনেও চর্মচক্ষে না দেখা খেলোয়াড়দের ভালবাসে। 

 

ব্রাজিলের ফাভেলা, আর্জেন্টিনার মফস্বলের অলিগলি কিংবা কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেলের কব্জায় থাকা শহরের অন্ধকার সামাজিক পরিবেশ আর দারিদ্যের কষাঘাতে প্রতিদিন মরতে থাকা পরিবারগুলোতে মুক্তির সুবাতাসের নাম ও এই একই ভালবাসা। এই ভালবাসার টানে দুই পায়ের জাদু দেখাতে মুগ্ধ হয়ে আছে শত শত শিশু কিশোর। আপনি তাদের লোভী বলতে পারেন, বলতে পারেন চারিত্রিকভাবে ভিন্ন কিংবা বলতে পারেন খেয়ালি। কিন্তু বল পায়ে প্রতিটি ল্যাটিন আমেরিকানের স্কিল তার স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। ওই মুহুর্তে খেলোয়াড় আর বল ছাড়া কিছুই আর দুনিয়াতে অর্থবহ হয়ে থাকেনা। চিন্তা করুন স্যান্টোসের হয়ে বাইসাইকেল কিক নেয়া পেলে কি ভাবছিলেন যখন মাঝ বাতাসে তার ডান পায়ের চামড়ার বুট ভারী বলটাকে ধরে ফেলেছিল। কিংবা ভাবুন ম্যারাডোনা কি ভেবে বলের গায়ে হাত ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। এই ভাবনার উত্তরের কোন কূলকিনারা হয় না। এগুলো বিশুদ্ধ আবেগে করে ফেলা কাজ। বল কাছে রাখার তাড়না, দলকে জিতিয়ে দেবার বাসনার প্রকাশ। আর এগুলোই ফুটবলের সৌন্দর্য্য। এর খোঁজেই চর্মগোলকের এই ধরাধামে এত মানুষের আগ্রহ। 

ছবিঃ Twitter @KMB9 / Dailymail UK

এক স্প্যানিশ “এজেন্ট” গতকাল ভিনিসিয়াসকে নিয়ে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছেন। এটা নিজেই জঘন্য একটা ব্যাপার। এর চেয়ে বড় জঘন্য বিষয় হচ্ছে সেটাও করা হয়েছে তার স্কিল এবং গোলের পর উদযাপনের দিকে তীর তাক করে। তবে তিনি একা নন, এটলেটিকো মাদ্রিদের কোকেও হুমকি দিয়েছেন গোলের পর উদযাপন করলে নাকি বেশ ঝামেলা হতে পারে তাঁর।

স্পেনে ল্যাটিন আমেরিকান প্রতিভাদের ছড়াছড়ি অনেকগুলো কারনেই। আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, ভাষার পাশাপাশি টেকনিকাল ঘরাণার ফুটবলে স্বাধীনভাবে খেলার সুযোগ পান বলেই ট্যাক্স নিয়ে বিস্তর ঝামেলার পরেও ল্যাটিন ফুটবলারদের জন্য স্পেন এখনো এক আমোঘ আকর্ষণ। ভিনিসিয়াস স্পেনে নতুন নন। চার বছর হয়ে গেছে লা লীগায় খেলছেন। কোপা ডেল রে ছাড়া স্পেনের সবগুলো শিরোপাই তিনি জিতে ফেলেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন সেগুলো জয়ের পথে বেনজেমার সাথে কাঁধ মিলিয়ে।

তাহলে হুট করেই এজেন্ট খেলোয়াড় সবাই তেতে ওঠার কারণ কি? খুব সাধারণ। সাফল্য। ভিনিসিয়াস এখন আর “সম্ভাবনা” নন। তিনি তারকা। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগের বর্তমান এবং ভবিষ্যত। ব্যালন ডি অর জিতবেন- বলে বার্সেলোনার নাম না জানা কোন এক ডিফেন্ডার টিপ্পনি কেটেছিলেন। এ বছর ব্যালন ডি অর অনুষ্ঠানে সেরা পাঁচের একজন হিসাবে ভিনিসিয়াসকে না দেখা গেলে সেটাই হবে অঘটন। তরুণ বয়সে মান নিয়ে টিপ্পনি কেটে দমানো যায় নি। দমানো যায় নি গত মৌসুমে এক মৌসুমের ওয়ান্ডার বলেও। এখন তাই এ ছাড়া আর উপায় নেই। বর্ণবাদ বহু পুরানো অস্ত্র। তার চেয়েও পুরাতন অস্ত্রের নাম হিপোক্রেসি- যেটা স্প্যানিশ ফুটবলে বহুল চর্চিত।

 

কোকে এন্টোনিও গ্রিজম্যানের সাথে খেলছেন কত বছর তা গুনতে দুই অঙ্কের ঘরে যেতে হবে। এর মধ্যে তার বিচিত্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে উৎকট ধরনের বহু উদযাপন ও দেখতে হয়েছে তাকে। তিনি আপত্তি করেননি কখনোই। কিন্তু ভিনিসিয়াসের উদযাপন তার গায়ে লাগছে। তার দলের বিপক্ষে পরের ম্যাচটাই যখন খেলতে নামবেন, এ ধরনের হুমকি একটা জিনিসই বিক্ষেপ করে। ভয়।

স্পেনে কিংবা ফ্রান্সে খেলার সময় প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার জন্য নেইমারকে কার্ড দেখানো হয়েছে। আজ স্পেনের অপ্রাসংগিক কোন এক এজেন্ট ভিনিসিয়াসকে স্কিল আর উদযাপনের জন্য বানর বলতেও পিছপা হচ্ছেন না। কৌতুহল হয় একই স্কিল ইতালিয়ান রক্ত বয়ে বেড়ানো কোন সাদা চামড়ার ল্যাটিন কিংবা স্প্যানিশ নাম জার্সিতে জড়ানো কোন বাস্ক, ক্যাটালান বা স্প্যানিশ করলেও একই মন্তব্য আসত কী না। ঐপনিবেশিক মানুষজনের অনেকের জন্যই ২২ বছর বয়সী তরুণের হাতে নাস্তানাবুদ হওয়া সাদা চামড়াদের দেখাটা হয়তো এতটাই অপমানজনক। কিন্তু ভিনিসিয়াস কি থামবেন?

গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সেমিফাইনালে স্বদেশী ফার্নান্দিনহোর ইউরোপিয়ান ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিলেন এক মুহুর্তের একটা মুভে। এই সাহস একদিনে আসেনি। বল পায়ে ভিনিসিয়াসকে আসতে দেখলে যে আতংক তৈরি হয় তা ভিনিসিয়াস হুট করে পান নি। ৪৫ মিলিয়নের ট্যাগের ভার বয়ে ওই কাধ শক্ত হয়েছে। ক্যাস্টিয়া থেকে ২৮ নাম্বার, ২৫ নাম্বার হয়ে ২০ নাম্বার জার্সি জড়িয়ে পা জোড়া হয়েছে পরিণত। ফুটবল মস্তিষ্ক শানিত হয়েছে বেনজেমার শাসন-আদরে।ক্যাসেমিরো-মার্সেলোদের হাতে জোড়া লেগেছে জীবনযাপনের পাঠ।  আর মাদ্রিদের পোস্টার বয় হিসাবে যে পরিচয় দাড়াচ্ছে মদ্রিচ-ক্রুস-কার্ভাহালদের সাথে খেলে তাকে আর যাই হোক এরকম ফাকা গুলির মত আওয়াজ করে দমানো যাবে না।

সমর্থক হিসাবে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের প্রতি সমর্থনটা আজ তাই নিঃসংকোচ। ভিনিশিয়াস দৌড়াবেন, ভিনিসিয়াস কাটিয়ে যাবেন প্রতিপক্ষকে, শুয়ে পড়বেন একের পর এক গোলরক্ষক, তারপর যখন পিছে তাকিয়ে তারা দেখবেন বল জালে ততক্ষণে ভিনিসিয়াস চলে যাবেন কর্ণার ফ্ল্যাগে। যার গায়ে জ্বালা ধরার ধরতে পারে, তার চামড়ার রং, তার হাসি, তার গায়ের জার্সির শুভ্রতা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের পোস্টার বয় হবার ভার- অনেক কিছুই অনেকের জ্বালা ধরানোর কারণ হতে পারে। কিন্তু ভিনিসিয়াসের জন্য বলের সাথে তার মিতালি হয়ে থাকুক মানুষ হিসাবে তার আনন্দের স্বাধীনতা। হয়ে থাকুক রিয়াল মাদ্রিদের রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক। 


________________________________

আসিফ হাসান জিসান
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক,
টুসান, এরিজোনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

You May Also Like