বিশ্বকাপের তিন চার সপ্তাহ আগে থেকেই রিয়াল মাদ্রিদ দল হিসাবে একটু ছন্নছাড়া হয়ে ছিল এটা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছিল। বিশ্বকাপের পর সেই ছন্নছাড়া ভাবের সাথে যোগ হয়েছিল ক্লান্তি। ব্রাজিল, ফ্রান্স আর স্পেন তিন দলের খেলোয়াড়ের আধিক্য যে দলে, যে দলের মিডফিল্ড জেনারেল খেলে এসেছেন বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী অব্দি- বিশ্বকাপে নিজ নিজ দলের ভিন্ন ধরনের হতাশাজনক ফল বা লম্বা ম্যাচ খেলার ক্লান্তি সেই দলে অবসাদ আনারই কথা। এই অবসাদের রেশ না কাটতেই সুপারকাপের ফাইনালে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। লা লীগাতে ৮ থেকে ১১ আবার ১১ থেকে ৮ এরকম একটা ব্যবধান নিয়ে খেলছে সেদিনের প্রতিপক্ষ বার্সেলোনা। এর মধ্যে ক্লাব বিশ্বকাপটাকে মনে হচ্ছিল একটা ঘোড়ারোগের মত।
কিন্তু সেই ক্লাব বিশ্বকাপ জিতে আসাটাই মনে হচ্ছে এই দলের চাবিতে দম দিয়ে ফেলল। লা লীগাতে শেষ দুই ম্যাচে কিছুটা গোছানো ফুটবল তার ই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। লিভারপুলের জন্য এই মৌসুমটা যাচ্ছে আরো বেশি খারাপ। ইনজুরী আর ফর্মের লুকোচুরিতে এই দলের শিরোপার আশাটাই টিকে আছে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের মধ্যে। তারাও শেষ দুই ম্যাচ জেতায় ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে “ফিরছে লিভারপুল” এই আশাবাদটা ছিলই। দুই দলের জন্য ইঞ্জিন পুরো চালু করতে দরকার ছিল এই ম্যাচে জয় ই।
এখানেই ম্যাচটা দুইভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে। প্রথম ২০ আর পরের ৭০। ২০ মিনিট যদি হয় লিভারপুলের নতুন পাওয়া মোমেন্টামের শো, তাহলে বাকি ৭০ মিনিট ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নদের নিখাদ টেকনিকাল, ট্যাকটিকাল এবং গুণগত মানের হাতে কলমে প্রদর্শনী। আপনি যদি ইংরেজিভাষী কোন সংবাদমাধ্যম অনুসরণ করেন, জেমি ক্যারাঘারের মত কিছু সীমিত দৃষ্টির বিশ্লেষন হয়তো শুনে ফেলেছেন। সেখানে বারবার বলা হচ্ছে- এলিসন বেকার ভুল করেছেন, জো গোমেজ খারাপ একটি ম্যাচ কাটিয়েছেন, কিংবা মৌসুম জুড়ে ইনজুরি জর্জর লিভারপুলের ডিফেন্স।
ক্লাব হিসাবে লিভারপুলের বয়স ১৩১ বছর। এই সুবিশাল ইতিহাসে কোনদিন লিভারপুল ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার হিসাবে ঘরের মাঠে চার গোল খায়নি। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সফলতম দল তাদের ঘরের মাঠে তাদের জালে ৫ বার বল পাঠিয়েছে। সেটাও দুই গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে এবং মাত্র ৪৩ মিনিটের ফুটবল খেলার মধ্যেই। এখানে কোন মিরাকল নেই। এখানে কোন আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনা নেই বা প্রতিপক্ষের ঢিলেমিকে কৃতিত্ব যদি দিতেই চান, রিয়াল মাদ্রিদের দূর্দমনীয় ফুটবল থেকে একরত্তি কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেবার কোন উপায় নেই। ম্যাচটাকে রিয়াল মাদ্রিদের দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে দেখতে পারি আমরা?
বেনজেমা-ভিনি-ভালভার্দের কাছেই বারে বারে নিষ্ক্রিয় হচ্ছে লিভারপুলের ডিফেন্সিভ সিস্টেম। Photo: Real Madrid Official Website
প্রথমে আসি ট্যাকটিকাল দিকে। কার্লো আনচেলত্তির ব্যাপারে ইংলিশ মিডিয়া একটা কথা বারবার বলে। সেটা হচ্ছে- কার্লো ট্যাকটিকালি অনেক গূঢ় তত্ত্ব দেয়া কোচের চেয়ে পিছিয়ে। তিনি সেরা ম্যানেজারের কাতারে পড়েন শুধুই তার খেলোয়াড় ম্যানেজমেন্টের কারিশমায়। ইয়ুর্গেন ক্লপের বিপক্ষে আনচেলত্তির এই মাস্টারক্লাস সম্ভবত এটার উত্তর দেবার জন্য খুবই ভাল একটি উদাহরণ। আনচেলত্তি কি কি ভাল করেছেন তার একটি তালিকা দেয়া যাক।
১। মাঝমাঠে লিভারপুলের তুলনামূলক ধীর মিডফিল্ডকে বারবার গতি পরিবর্তনের ফাঁদে ফেলা।
২। বার বার গোমেজকে টার্গেট করে ভ্যান ডাইককে তার জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা।
৩। কার্ভাহাল-নাচোকে তিনটা আলাদাভাবে ব্যবহার করে আলেকজান্ডার আর্নলড আর রবার্টসনের উইং ওভারলোডকে একরকম বোতলবন্দী করে ফেলা।
তরুণ খেলোয়াড়দের একদমই না নামানো আর ৫ নাম্বার সাবস্টিটিউট ব্যবহার করাকে বাদ দিলে কার্লো আনচেলত্তির কাছ থেকে বাকি জিনিসটা ক্লপ, টুখেল কিংবা অন্য যে কোন ইউরোপিয়ান কোচ একটা রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে নিতে পারেন যার হেডলাইন হবে “অতি আক্রমণাত্বক দলের বিপক্ষে আদর্শ ট্যাকটিক্স”। সিস্টেম হেভি কোচদের ধ্বংস করে ফেলার নজির কার্লোর জন্য অবশ্যই এটা প্রথম নয়। গার্দিওলা কিংবা ক্লপকে এর আগেও নাজেহাল করার নজির আছে তার বহুবার। এর কারণ এটাই যে কার্লো আনচেলত্তির কোন বাধাধরা দল দর্শন নেই। যিনি ওষুধ নিয়ে কাজ করেন তাকে হয়তো রোগ আকড়ে ধরে বাঁচতে হয়না।
এবার আসি এই পাজলের দ্বিতীয় ভাগে। কার্লো আনচেলত্তি এই ট্যাকটিকাল প্রদর্শন কি তার নাপোলি কিংবা এভারটন দলটা নিয়ে করতে পারতেন? উত্তর হচ্ছে- “না”। ক্লপ কিংবা ক্লপের পরবর্তী গেগেনপ্রেসিং ঘরাণার বিবর্তনকারী টুখেল- দুইজনই নিজের সিস্টেম নিয়ে প্রায় আপোষহীন। সিস্টেমের কাছে খেলোয়াড়েরা বলি হয়ে যান খুব সহজেই। কার্লো আনচেলত্তি সেখানে তার কাজই শুরু করেন “হাতে কি আছে, সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহারটা কীভাবে সম্ভব?” এখান থেকে। খেলোয়াড় তাই যত ভাল- আনচেলত্তি তত ভাল কোচ। খেলোয়াড়দের সামর্থ্যে এখানে সিস্টেম পরিবর্তিত হয়, সিস্টেমের পূনর্জন্ম হয় প্রতি মৌসুমে, অনেক সময় একই মৌসুমে একাধিকবার। এই প্রক্রিয়াতেই কখনো এঙ্গেল ডি মারিয়া সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে, ফেদে ভালভার্দে রাইট উইং পজিশানে কিংবা রড্রিগো গো’স রা এটাকিং মিডফিল্ডে নতুন করে নিজেদের ধরতে পারেন। কিন্তু এই বিষয়গুলো কাজ করতে শর্ত একটাই- টেকনিকাল পারফেকশান। রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ড এবং আক্রমণে প্রতিপক্ষকে রীতিমত নাজেহাল করেছে বারেবারে। এরও তিনটা উদাহরণ দিয়ে দিই।
১। ম্যাচের ২০ মিনিটে ভিনিসিয়াস যখন প্রথম গোলে শট নেন সেটা বেশ কঠিন কোণ ছিল গোল থেকে। তাকে অনেক সমালোচনায় বিদ্ধ গোমেজের সাথে মার্ক করছিলেন ফ্যাবিনহো আর আলেক্সান্ডার আর্নর্ল্ড ও। কিন্তু এখানে মানের পার্থক্য এতটাই বেশি যে এদের সাথে এলিসনের মত গোলকীপারের বাধাও ভিনিকে আটকাতে যথেষ্ট ছিল না।
২। ম্যাচের ৪৫ মিনিটেই আসলে রিয়াল মাদ্রিদ সমতাসূচক গোলটা করে ফেলতে পারত। রড্রিগো শেষ মুহুর্তে রবার্টসনের ট্যাকলের শিকার হয়ে যান। কিন্তু এই আক্রমণের বিল্ড আপ শুরু হয়েছিল কোর্তোয়ার থ্রো থেকে। যেটার শেষে ভিনিসিয়াস বল বাড়িয়েছিলেন রড্রিগোকে। কিন্তু এর মাঝে ছিলেন ফেদে ভালভার্দে এবং সেটা বাম টাচলাইন বরবার! ফেদে ভালভার্দে ২৩ থেকে ৪৩ এই ২০ মিনিটের মাঝে key pass বাড়িয়েছেন চারটি। প্রতিটি আবার মাঠের পুরোপুরি ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে। লিভারপুলের মিডফিল্ডের কারো গোটা ম্যাচেই তিনটা key pass নেই।
৩। এরপর অবশ্যই পঞ্চম গোল। এখানে মদ্রিচের গতি, ভিনিসিয়াসের বল ছাড়ার পরিমিতিবোধ এবং বেনজেমার প্রথম এবং দ্বিতীয় টাচ- সবগুলোই মানের বিচারে ইউরোপের সেরা দলের মুকুট পড়ে থাকা দলের মানের statement.
Modric Vinicius Benzema
Real Madrid’s 𝟓𝐭𝐡 goal against Liverpool was pic.twitter.com/e1aV5rXzMB
— Sport360Football (@Sport360Foot) February 23, 2023
এই ছোট ছোট মুহুর্তগুলোই আপনাকে বড় ম্যাচে এগিয়ে দেবে। এই মুহুর্তগুলোই যোগ হয়ে হয়ে আপনাকে দেবে ৫ গোল করা দলের superiority.
শেষে মানে তৃতীয় ভাগে আসতে হবে গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে। মানসিক শক্তি। ম্যাচের ২০ মিনিটে রিয়াল মাদ্রিদ আর ম্যাচের ৪৭ মিনিটে লিভারপুল দুই দলের শারীরিক ভাষার দিকে যদি তাকান তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন ম্যাচের ফলাফল ৫-২। প্রথম ক্ষেত্রে রিয়াল মাদ্রিদ ছিল ২ গোলে পিছিয়ে পড়া দল। তাদের গোলরক্ষক মাত্র একটা গোল উপহার দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু সেই দলের ২২ বছর বয়সী তরুণ আর ৩৫ আর ৩৭ বছর বয়সী দুই সিনিয়র মিলে বাকিদের বলছেন শান্ত থাকতে। প্রথম গোলের পর সেই ২২ বছর বয়সী তরুণ উদগ্র হায়েনার মত প্রেস করছেন প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে! রিয়াল মাদ্রিদ যদি টেকনিকালি আর ট্যাকটিকালি এই ম্যাচে এগিয়ে নাও থাকত- শুধু মানসিকভাবে এই দানবীয় উপস্থিতিই যথেষ্ট একটা দলকে একের পর এক মিরাকলের জন্মদাতা বানিয়ে ফেলতে।
The reaction of Real Madrid players when 0-2 down vs Liverpool. Calma, calma.
They knew, this is Real Madrid. pic.twitter.com/5BA5MXIqL9
— TC (@totalcristiano) February 22, 2023
৪৭ থেকে ৭০ এই সময়টাতে ৩-২ গোলে পিছিয়ে পড়া লিভারপুল সেখানে দেখিয়েছে ভয় কীভাবে যে কোন দলকে অর্ধেক করে ফেলতে পারে সামর্থ্যে আর বিবেচনায়। ৭০ মিনিটের পর রিয়াল মাদ্রিদ প্রায় খেলায় জোর দেয়া থামানোর পর তারা ম্যাচে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত এসেছে ঠিকই। কিন্তু ততক্ষনে এনফিল্ডের গ্যালারিতে লাল অংশের পিনপতন নীরবতা ভেদ করে শুধুই শোনা যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের “ওলে! ওলে! ওলে!” ধ্বনি। সেটার ফাঁকে ফাঁকে কখনো বাজছে “Asi ! Asi ! así gana el Madrid!” কিংবা লুকা মদ্রিচের মাঠ থেকে উঠে যাবার সময় সম্মিলিত করতালি।
এইসব ম্যাচ দলের ভুল বের করার ম্যাচ নয়। তবুও যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বলা যেতে পারে সুযোগ ছিল আরো একটা গোল করে ম্যাচটাকে ধরাছোয়ার বাইরে নিয়ে যাবার। লিভারপুলের গোলদু’টির মধ্যে প্রথমটাতে কামাভিঙ্গা হয়তো আরেকটু দ্রুত রিয়াক্টিভ হতে পারতেন। কিংবা শেষ ১০ মিনিটে সেবায়োস আসেন্সিওর সাথে টনি ক্রুসকে না নামিয়ে আরেকটু ক্ষুধার্ত কোন তরুণকে নামিয়ে দিলে একটা গোল বেশি হয়ে যেতেই পারত। কিংবা হ্যাটট্রিকটা ভিনিসিয়াস বা বেনজেমা করতে আরেকটু চেষ্টা করতেই পারতেন শেষ ১০ মিনিট পাস প্র্যাকটিস আর ওলে ওলের লোভটা সামলিয়ে।
কিন্তু, মৌসুমের এই পর্যায়ে ইনজুরি কাটিয়ে বেনজেমা ফিরতে শুরু করেছেন নিজের চেহারায়, মানসিকভাবে ভিনিসিয়াস জয় করতে শুরু করেছেন তার সামনের চ্যালেঞ্জগুলিকে, কামাভিঙ্গা কাটিয়ে উঠছেন তার অনিশ্চিত ভাবটা। সর্বোপরি ক্রুসের হুট করে স্কোয়াডে ফেরা, লেফটব্যাক হিসাবে নাচোকেও গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে ব্যবহার করতে পারা কিংবা রুডিগার, কার্ভাহাল হয়ে মিলিতাও এর প্রায় পুরো গেমেই উন্নতি- এতগুলো ভাল জিনিস ও ব্যাগে ভরে বার্নাব্যুতে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা উপভোগ না করে উপায় নেই।
হয়তো মৌসুমে ধুকতে থাকা প্রিমিয়ার লীগের দলকে হারানো অত বড় বার্তা দেয়না যতটা আমরা ভাবছি। হয়তো ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবার দেখা হওয়ার পরই লিভারপুলকে হতাশ করা দল হিসাবে এটা হওয়া উচিত আমাদের নিয়মিত খেলাই। হয়তো ২ গোলে পিছিয়ে পড়ার আগেই এই দানবীয় চেহারাটা দেখাতে পারা উচিত ছিল আমাদের।
কিন্তু সব শেষে আপাতত মাথায় গেঁথে রাখুন- গত মৌসুমে যে কাজটা ৯০ মিনিট খেলে আসার পর শুরু হত আমরা সেটা ২০ মিনিট যেতেই হয়তো শুরু করতে পারছি। আমাদের বুড়ো দলটা তাদের সাইকেলের শেষ প্রান্তে এসেও উন্নতি করছে। তরুণ খেলোয়াড়েরা জড় করছেন mentality monster হয়ে ওঠার সবটুকু রসদ। আর শেষে? শেষে ইউরোপের অন্যতম কঠিন পরিবেশের জন্য বিখ্যাত এনফিল্ডে পতপত করে উড়ছে রিয়াল মাদ্রিদের জয়ের পতাকা।
প্রশ্নটা এখন এটাই, আবারো একবার, হবে কী?
____________________________________________________
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
আসিফ হাসান জিসান
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক
টুসান, এরিজোনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রথমত ৩০ জনের তালিকা। এটা নির্বাচনে জনমানুষের কোন ধরনের হাত নেই। ফরাসী সাপ্তাহিক “French football” এর “বিশেষজ্ঞ” সম্পাদকের একটি দল নিজেদের পছন্দমত একটি তালিকা তৈরি করে ফেলেন। তারপর সেই তালিকার ওপর হয় ভোট। এই ভোটে FIFA Ballon D’Or নাম থাকাকালীন জাতীয় দলের অধিনায়ক এবং কোচেরা ভোট দিতে পারতেন। কিন্তু এখন আগের মত ভোট দেন “France Football” এর নির্বাচিত একদল সাংবাদিক ই। এদের পরিচয় ও গোপন থেকে যায়।
এখন কিসের উপরে তারা ভোট দিতে পারেন?
১। প্রথমত পারফরমেন্স। গত মৌসুম জুড়ে কে কেমন পারফর্ম করেছেন।
২। খেলোয়াড়ের ব্যবহার ও স্পোর্টসম্যানশীপ।
৩। খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার নিয়ে মতামত।
এই তিনটি বিষয়ের উপরে ভোট দিয়ে গত এক মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটা যে কিছুটা একপেশে হতে পারে, সেটার গল্পটাও এই দুই আর তিন নাম্বার শর্তের মধ্যেই লুকানো। কিংবা একদল বুর্জোয়া সাংবাদিক যাদেরকে আপনি ঠিকমত চেনেন ও না, তারা যে তাদের মতামতে আপনার চ্যাম্পিয়নকে দাবিয়ে দিতে পারেন সেটাও ঠিক করে দিতে পারে ২ এবং ৩ নাম্বার ঘরটিই। তাই ব্যালন ডি অরের সাথে সকলের চোখে সেরা খেলোয়াড়কে পুরষ্কার দেয়া হয় বিষয়টা যেমন তা নয়, সেরকম একটি মৌসুমে ভাল খেললে তাতে বুর্জোয়া নির্বাচকেরা তাদের একপেশে পক্ষপাতিত্বমূলক মতামত আপনার ওপর চাপিয়ে দেবেন না এটার নিশ্চয়তাও ব্যালন ডি অরের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় একেবারেই নেই।
গত মৌসুমে করিম বেনজেমা ২০২১-২২ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ৪৬ ম্যাচে করেছেন ৪৪ গোল। সাথে তার বাড়িয়ে দেয়া বল থেকে দল গোল পেয়েছে আরো ১৫ বার। দলের জন্য প্রতি ৬৬ মিনিটে কমপক্ষে একটি গোল করতে ভূমিকা রেখেছেন। এ তো গেল ব্যাক্তিগত হিসাব। দলের হয়ে এক কোপা ডেল রে বাদে জিতেছেন সবগুলো ট্রফি। পরিসংখ্যানের বোকা সংখ্যার জগতে বিচরণ শেষ করে “খেলা দেখেছেন কী আদৌ?” তর্কে যদি যেতে চান সেখানে বেনজেমা আরো অনেক বেশি উজ্জ্বল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে দু’টি হ্যাটট্রিক। পি এস জি আর চেলসির বিপক্ষে সেই দু’টি হ্যাটট্রিক শুধু তিনটি গোল নয়, রীতিমত পাহাড় ঠেলার গল্প। প্রতিবার দলের জন্য ঠিক যখন দরকার হয়েছে জ্বলে উঠেছেন। সেমিফাইনালে সিটির বিপক্ষে পানেনকা পেনাল্টি কিংবা গত সপ্তাহের এল ক্লাসিকোতে গোল- রিয়াল মাদ্রিদের জন্য করিম বেনজেমা অনেক বড় বড় নামের চেয়েও যে আসলে কত বড় এটা বুঝতে খুব বেশি ফুটবল ও বুঝতে হয় না। তার স্বীকৃতি হিসাবেই ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার UEFA Player of the Year জিতেছেন। সব ঠিক থাকলে FIFA The best জিততেও কোন সমস্যা হবার তার কারণ নেই। তাই বেনজেমাই যে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় এর স্বীকৃতি হিসাবে তার ব্যালন ডি অর জেতা অত্যাবশ্যক ছিল না। এটা কেবলই তার অসামান্য অর্জনে একটা অতিরিক্ত পালক। এটাকে আমি একটি আনুষ্ঠানিকতার বেশি মানতে একেবারেই নারাজ।
ব্যালন ডি অরের ঠিক আগে আগে ফ্রান্স ফুটবলের প্রেসিডেন্ট বলে বসলেন “রিয়াল মাদ্রিদ জানে কীভাবে মৌসুম চালালে তাদের খেলোয়াড় ব্যালন ডি অর জিতবে। ফ্লোরেন্তিনো যা করেন জেনে বুঝেই করেন।” পেশাদার ফুটবলের সফলতম দলের একটি হিসাবে ফুটবলকে রিয়াল মাদ্রিদ দলগত খেলার বাইরে আর কিছু হিসাবে দেখে, এরকম ধারণাটি শুধু যে ভুল তাই নয়, রীতিমত অপমানজনক।
ছবিঃ MARCA
আধুনিক ফুটবল স্যার গর্ডন ব্যাংক্স বা আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর মত চ্যাম্পিয়ন উপহার দিলেও তাদেরকে আমরা নাও চিনতে পারি। মিউনিখ ট্রাজেডির মত এখন রিয়াল মাদ্রিদ তাদের সেরা দুই খেলোয়াড়কে হয়তো কাউকে দিয়ে দিতে চাইতেও পারবেনা। পেশাদারিত্বের এই যুগে সবই মার্কেটিং, সবই ক্যাম্পেইনের জোরে করে ফেলা যায়। চাইলে আপনি এই যুগে মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট যেটা চার বছরে একবার হবার কথা সেটাকে দশ বছরে ছয়বার করে ফেলতে পারেন, কনফেডারেশান্স কাপের মত জনপ্রিয় টুর্নামেন্টকে মেরে ফেলতে পারেন, নেশন্স লীগের মত প্রীতিম্যাচগুলোকে জোড়া দিয়ে টুর্নামেন্ট ও বানিয়ে ফেলতে পারেন, সুপারলীগের বিরোধীতা করে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফরম্যাটকেই এমনভাবে নাড়িয়ে দিতে পারেন যেন সেটাকে আর চেনাই না যায়। এসব করেও মন না ভরলে বিশ্বকাপটাকে পেশাদার মৌসুমের মাঝে এনে পুরো মৌসুম এবং বিশ্বকাপ দুটোকেই বরবাদ করে দিতে পারেন। এগুলোর কিছুতেই দর্শক বা খেলোয়াড়দের মতামত নেবার দরকার হয় না। অন্ধকারে থাকা বুর্জোয়ারা ঠিক করে দিতে পারেন আপনি কীভাবে ফুটবল দেখবেন বা কীভাবে তাদের পকেটে দেখার বিনিময়ে আরো টাকা ঢেলে দেবেন। ফরাসী ফুটবলে জীবাশ্ন জ্বালানীর অর্থের এখন এমনই দাপট, তাদের লীগ সহ পুরো ফুটবলীয় প্রক্রিয়ায় এখন এতই রাষ্ট্রীয় কূটনীতির প্রভাব যে, অতীত ঐতিহ্যের পরাকাষ্ঠা থেকে ফ্রান্স ফুটবল দুনিয়ার সেরা বিচার বিশ্লেষন উপহার দেয়- এই চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসার সময়টা অনেক আগেই হয়ে গেছে।
এরপর ও করিম বেনজেমার ব্যালন ডি অর উদযাপন করতেই পারেন। করতে পারেন এজন্য যে খেলোয়াড় করিম জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে দলের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ছিলেন প্রতি মুহুর্তে, এজন্য যে তিনি ১০ বছর ধরে অন্যদের সেরা হতে সাহায্য করেছেন, কঠিন সময় পার করেছেন এবং মানুষের নিন্দা, ঘৃণা পার করে আজ নিজের জন্য পেয়েছেন অর্জিত এবং প্রাপ্য সম্মান। জিদানের হাত থেকে পুরষ্কার নিয়ে জিদানকে সঠিক প্রমাণ করেছেন এবং রিয়াল মাদ্রিদের পালকে যোগ করেছেন আরো সাফল্যের রং।
বেনজেমার জন্য আপনি খুশী হবেন তার অসামান্য অর্জনের জন্য, তার ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের জন্য। কিন্তু ব্যালন ডি অর কি আসলেই ব্রাহ্মণ্যের তীলক? 2014-15 মৌসুমে দলের সবচেয়ে বড় সমর্থক বেনজেমার স্মৃতিচারণ। ছবিঃ GOAL
কিন্তু মনে রাখুন, মৌসুম চলা সত্ত্বেও পুরষ্কারটাই গিলে ফেলা, নিজেদের পছন্দের খেলোয়াড়কে এক ট্রফির বিনিময়ে পুরষ্কার দিয়ে দেয়া, ভিনিসিয়াসকে আট নাম্বারে ফেলে দেয়া, কিংবা গোজামিল গ্রহনযোগ্য হবেনা বুঝতে পেরে “সেরা স্ট্রাইকার” নামে পুরষ্কার চালু করা আর মৌসুমের ফলাফলের সাথে অসম্পর্কিত “সেরা ক্লাবের” পুরষ্কার বানানো একদল ফরাসী বুর্জোয়ারা সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন বলে বেনজেমা সেরা হচ্ছেন বিষয়টা এমন নয়। বেনজেমা বরং গত মৌসুমের ও সেরা খেলোয়াড়ই ছিলেন। ব্যালন ডি অরের পক্ষপাতিত্বে চারের বেশি নিজেকে দেখতে পারেননি তিনি।
বরং এটার জন্য এই ব্যালন ডি অর গুরুত্বপূর্ণ যে, বেনজেমা এতটাই ভাল খেলেছেন যে পক্ষপাতদূষ্ট, নাক উচু এবং হাস্যকর বিচারবুদ্ধির একদল বুর্জোয়াও বেনজেমার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্ন করতে পারেনি।
করিম মোস্তফা বেনজেমা, বিশ্বের সেরা হিসাবে এতটাই তর্কাতীত।
_______________
আসিফ হাসান জিসান
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক,
টুসান, এরিজোনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রাজিলের ফাভেলা, আর্জেন্টিনার মফস্বলের অলিগলি কিংবা কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেলের কব্জায় থাকা শহরের অন্ধকার সামাজিক পরিবেশ আর দারিদ্যের কষাঘাতে প্রতিদিন মরতে থাকা পরিবারগুলোতে মুক্তির সুবাতাসের নাম ও এই একই ভালবাসা। এই ভালবাসার টানে দুই পায়ের জাদু দেখাতে মুগ্ধ হয়ে আছে শত শত শিশু কিশোর। আপনি তাদের লোভী বলতে পারেন, বলতে পারেন চারিত্রিকভাবে ভিন্ন কিংবা বলতে পারেন খেয়ালি। কিন্তু বল পায়ে প্রতিটি ল্যাটিন আমেরিকানের স্কিল তার স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। ওই মুহুর্তে খেলোয়াড় আর বল ছাড়া কিছুই আর দুনিয়াতে অর্থবহ হয়ে থাকেনা। চিন্তা করুন স্যান্টোসের হয়ে বাইসাইকেল কিক নেয়া পেলে কি ভাবছিলেন যখন মাঝ বাতাসে তার ডান পায়ের চামড়ার বুট ভারী বলটাকে ধরে ফেলেছিল। কিংবা ভাবুন ম্যারাডোনা কি ভেবে বলের গায়ে হাত ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। এই ভাবনার উত্তরের কোন কূলকিনারা হয় না। এগুলো বিশুদ্ধ আবেগে করে ফেলা কাজ। বল কাছে রাখার তাড়না, দলকে জিতিয়ে দেবার বাসনার প্রকাশ। আর এগুলোই ফুটবলের সৌন্দর্য্য। এর খোঁজেই চর্মগোলকের এই ধরাধামে এত মানুষের আগ্রহ।
ছবিঃ Twitter @KMB9 / Dailymail UK
এক স্প্যানিশ “এজেন্ট” গতকাল ভিনিসিয়াসকে নিয়ে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছেন। এটা নিজেই জঘন্য একটা ব্যাপার। এর চেয়ে বড় জঘন্য বিষয় হচ্ছে সেটাও করা হয়েছে তার স্কিল এবং গোলের পর উদযাপনের দিকে তীর তাক করে। তবে তিনি একা নন, এটলেটিকো মাদ্রিদের কোকেও হুমকি দিয়েছেন গোলের পর উদযাপন করলে নাকি বেশ ঝামেলা হতে পারে তাঁর।
স্পেনে ল্যাটিন আমেরিকান প্রতিভাদের ছড়াছড়ি অনেকগুলো কারনেই। আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, ভাষার পাশাপাশি টেকনিকাল ঘরাণার ফুটবলে স্বাধীনভাবে খেলার সুযোগ পান বলেই ট্যাক্স নিয়ে বিস্তর ঝামেলার পরেও ল্যাটিন ফুটবলারদের জন্য স্পেন এখনো এক আমোঘ আকর্ষণ। ভিনিসিয়াস স্পেনে নতুন নন। চার বছর হয়ে গেছে লা লীগায় খেলছেন। কোপা ডেল রে ছাড়া স্পেনের সবগুলো শিরোপাই তিনি জিতে ফেলেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন সেগুলো জয়ের পথে বেনজেমার সাথে কাঁধ মিলিয়ে।
তাহলে হুট করেই এজেন্ট খেলোয়াড় সবাই তেতে ওঠার কারণ কি? খুব সাধারণ। সাফল্য। ভিনিসিয়াস এখন আর “সম্ভাবনা” নন। তিনি তারকা। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগের বর্তমান এবং ভবিষ্যত। ব্যালন ডি অর জিতবেন- বলে বার্সেলোনার নাম না জানা কোন এক ডিফেন্ডার টিপ্পনি কেটেছিলেন। এ বছর ব্যালন ডি অর অনুষ্ঠানে সেরা পাঁচের একজন হিসাবে ভিনিসিয়াসকে না দেখা গেলে সেটাই হবে অঘটন। তরুণ বয়সে মান নিয়ে টিপ্পনি কেটে দমানো যায় নি। দমানো যায় নি গত মৌসুমে এক মৌসুমের ওয়ান্ডার বলেও। এখন তাই এ ছাড়া আর উপায় নেই। বর্ণবাদ বহু পুরানো অস্ত্র। তার চেয়েও পুরাতন অস্ত্রের নাম হিপোক্রেসি- যেটা স্প্যানিশ ফুটবলে বহুল চর্চিত।
কোকে এন্টোনিও গ্রিজম্যানের সাথে খেলছেন কত বছর তা গুনতে দুই অঙ্কের ঘরে যেতে হবে। এর মধ্যে তার বিচিত্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে উৎকট ধরনের বহু উদযাপন ও দেখতে হয়েছে তাকে। তিনি আপত্তি করেননি কখনোই। কিন্তু ভিনিসিয়াসের উদযাপন তার গায়ে লাগছে। তার দলের বিপক্ষে পরের ম্যাচটাই যখন খেলতে নামবেন, এ ধরনের হুমকি একটা জিনিসই বিক্ষেপ করে। ভয়।
Sempre! https://t.co/VjjN9MtwwV pic.twitter.com/B4K08fLs10
— Vini Jr. (@vinijr) September 16, 2022
স্পেনে কিংবা ফ্রান্সে খেলার সময় প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার জন্য নেইমারকে কার্ড দেখানো হয়েছে। আজ স্পেনের অপ্রাসংগিক কোন এক এজেন্ট ভিনিসিয়াসকে স্কিল আর উদযাপনের জন্য বানর বলতেও পিছপা হচ্ছেন না। কৌতুহল হয় একই স্কিল ইতালিয়ান রক্ত বয়ে বেড়ানো কোন সাদা চামড়ার ল্যাটিন কিংবা স্প্যানিশ নাম জার্সিতে জড়ানো কোন বাস্ক, ক্যাটালান বা স্প্যানিশ করলেও একই মন্তব্য আসত কী না। ঐপনিবেশিক মানুষজনের অনেকের জন্যই ২২ বছর বয়সী তরুণের হাতে নাস্তানাবুদ হওয়া সাদা চামড়াদের দেখাটা হয়তো এতটাই অপমানজনক। কিন্তু ভিনিসিয়াস কি থামবেন?
গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সেমিফাইনালে স্বদেশী ফার্নান্দিনহোর ইউরোপিয়ান ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিলেন এক মুহুর্তের একটা মুভে। এই সাহস একদিনে আসেনি। বল পায়ে ভিনিসিয়াসকে আসতে দেখলে যে আতংক তৈরি হয় তা ভিনিসিয়াস হুট করে পান নি। ৪৫ মিলিয়নের ট্যাগের ভার বয়ে ওই কাধ শক্ত হয়েছে। ক্যাস্টিয়া থেকে ২৮ নাম্বার, ২৫ নাম্বার হয়ে ২০ নাম্বার জার্সি জড়িয়ে পা জোড়া হয়েছে পরিণত। ফুটবল মস্তিষ্ক শানিত হয়েছে বেনজেমার শাসন-আদরে।ক্যাসেমিরো-মার্সেলোদের হাতে জোড়া লেগেছে জীবনযাপনের পাঠ। আর মাদ্রিদের পোস্টার বয় হিসাবে যে পরিচয় দাড়াচ্ছে মদ্রিচ-ক্রুস-কার্ভাহালদের সাথে খেলে তাকে আর যাই হোক এরকম ফাকা গুলির মত আওয়াজ করে দমানো যাবে না।
সমর্থক হিসাবে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের প্রতি সমর্থনটা আজ তাই নিঃসংকোচ। ভিনিশিয়াস দৌড়াবেন, ভিনিসিয়াস কাটিয়ে যাবেন প্রতিপক্ষকে, শুয়ে পড়বেন একের পর এক গোলরক্ষক, তারপর যখন পিছে তাকিয়ে তারা দেখবেন বল জালে ততক্ষণে ভিনিসিয়াস চলে যাবেন কর্ণার ফ্ল্যাগে। যার গায়ে জ্বালা ধরার ধরতে পারে, তার চামড়ার রং, তার হাসি, তার গায়ের জার্সির শুভ্রতা কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের পোস্টার বয় হবার ভার- অনেক কিছুই অনেকের জ্বালা ধরানোর কারণ হতে পারে। কিন্তু ভিনিসিয়াসের জন্য বলের সাথে তার মিতালি হয়ে থাকুক মানুষ হিসাবে তার আনন্দের স্বাধীনতা। হয়ে থাকুক রিয়াল মাদ্রিদের রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক।
________________________________
আসিফ হাসান জিসান
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক,
টুসান, এরিজোনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বক্সের বাইরে আসেন্সিওর সঙ্গে খুব নীরিহ ধরনের একটা ওয়ান টু করে আগাচ্ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রাণভোমরা। এরপর হুট করেই শট। বিশ্বকাপের পর দুনিয়াজোড়া নাম ছড়িয়ে পড়া গুইলিরিমে ওকোচার জন্য এই গোল খেয়ে বসাতে কোন ব্যর্থতা নেই। এই শট দুনিয়ার কোন গোলকীপারের ই থামানোর সামর্থ্য নেই। কোনদিন ছিল ও না। করিম মোস্তফা বেনজেমা যেন শুরু করলেন ঠিক সেখান থেকে যেখানে নিজেকে রেখে গত মৌসুম শেষ করেছিলেন। সেই জায়গার নাম- দুনিয়াজোড়া ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব।
@fede98000 Karim Benzema goal vs club America #fede980 ♬ sonido original – FBG
বিশ্বের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় কে? এই প্রশ্নের উত্তরে তথ্য, উপাত্ত, বিচার কিংবা বিশ্লেষনের একটা ভূমিকা আছে অবশ্যই। করিম বেনজেমার পক্ষে আপনি বলতে পারবেন এই নিরিখে অনেক কিছুই। লা লীগার সর্বোচ্চ গোলদাতা, চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, দুই টুর্নামেন্টের ই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু করিম বেনজেমাকে সময়ের শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে তার উপস্থিতির ভূমিকাটাই।
বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় তার মুন্সিয়ানা দেখাতে ৯০ মিনিট জুড়েই ভাল খেলেন এমনটা নয়। ২০১২-১৩ সালের লিওনেল মেসির কথা ভাবুন। ওই সময়ের ম্যাচগুলো ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। মেসি গোল করবেন ই। কিংবা ভাবুন ২০১৬-১৭ সালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথাই। এটলেটিকো মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাস- যে আসছে সামনে রোনালদোর সামনে অসহায় তাদের ডিফেন্স। তুলোধুনো হচ্ছে সবাই। এই খেলোয়াড়দের চলনে, নড়নে চড়নে ঠিকরে বের হত শ্রেষ্ঠত্ব। এবার করিম বেনজেমার দিকে তাকান। এই গত মৌসুমেই তো পি এস জি, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে জুজু হয়ে এসে ভয় দেখিয়েছেন সবাইকে। সেই ভয় বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এ যেন অবশ্যম্ভাবী এক বিপর্যয়। আপনার দল যদি রিয়াল মাদ্রিদের সামনে পড়েই যায়, করিম বেনজেমা নামের এই বিপর্যয় আপনার কপালে জুটবেই। আর যদি ভয় পেয়ে তাকে বাধা দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বসেন? তাহলে ভিনিশিয়াস জুনিয়র নামে তার ভাবশিষ্য আপনাকে ভুগিয়ে মারবেন।
আধুনিক স্ট্রাইকারদের জন্য বেনজেমার প্রতিটি মুভমেন্ট ই হতে পারে এখন গবেষনা আর শিক্ষার উপকরণ (ছবিঃ Premier Sports)
বেনজেমার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটে এমনিই পালকের অভাব নেই। এই ধরুন খুব সহজেই তর্ক বাধিয়ে দেয়া যায় যে রোনালদো যে দল নিয়ে ইউরোপ জয় করেছিলেন, বেনজেমা তার ইউরোপ জয়ের পথে সে দলের বুড়িয়ে যাওয়া ছায়ায় ঢাকা একটা সংস্করণের বেশি কিছু পান নি। কিন্তু ১৬ গোল করা এবং ট্রফি উচিয়ে ধরায় রোনালদোর চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন কি কোথাও? একদমই না। রোনালদোকে বলা যায় আধুনিক ফুটবলের নতুন যুগের প্রোটোটাইপ। ইতিহাসের সেরা হাইব্রিড উইঙ্গার। হাইব্রিড উইঙ্গার কিংবা ফলস নাইনদের জ্বালাতনে আধুনিক যুগে ক্লাসিক নাম্বার ৯ হারিয়ে যাচ্ছে বলে যখন হাহাকার, বেনজেমা সেখানে আধুনিক নাম্বার ৯ দের জন্য একদম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া বিজ্ঞাপন। তিনি রোনালদোর জন্য প্লেমেকার ছিলেন। ছিলেন ফলস নাইন। এসব করতে গিয়ে ফিনিশিং এ ধার হারিয়ে সমালোচনাও কম শোনেননি। বয়স ৩০ হয়ে গেছে, এরপরে কি কেউ বদলায়? বেনজেমা বদলান নি। রোনালদো চলে যাবার পর নিজের ওপর অর্পিত খোলসটা ঝেড়ে ফেলেছেন। অলিম্পিক লিওনের সেই দুরন্ত প্রতিভাকে নিয়ে এসেছেন লাইমলাইটে। কি নেই সেই খেলোয়াড়ের মধ্যে? গতি, ড্রিবলিং, পাওয়ার, স্কিল তো আছেই। সেই কেক এর ওপরে চেরি হয়ে আছে প্রায় অপার্থিব ফার্স্ট টাচ। এতটাই মোলায়েম সেই টাচ যে সেটার অলসতা আপনাকে ধোঁকা দিয়ে বসবে!
২০০৯ সালে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ নিজে গিয়েছিলেন করিম বেনজেমার বাড়িতে। তাকে তিনি দলে ভিড়িয়েছিলেন নিজের, জিনেদিন জিদানের আর রিয়াল মাদ্রিদের গ্ল্যামারের সর্বোচ্চ ঝলক দেখিয়ে। বলেছিলেন বেনজেমার মধ্যে রোনালদো নাজারিও আর জিনেদিন জিদানের খেলোয়াড়ি সত্ত্বার মিলন দেখেন। এটা নিয়ে হাসিঠাট্টা কম হয়নি। কিন্তু বেনজেমার অলস টাচে যদি জিদানের স্নেহধন্যতার পরিচয় পান, গতকালকের এই গোলটার মধ্যে কি রোনালদো নাজারিওর মত জেনে বুঝে ধ্বংসের আবাহন একটুও দেখেন না?
এই তুলনায় এখন আর হালকা রসিকতার ছোঁয়া নেই। বরং বেনজেমাই এখন জোরগলায় বলতে পারেন নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী (ছবিঃ Real Madrid Website)
৩৪ বছর বয়সী বেনজেমা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শুরু করতে যাচ্ছেন তার ১৪তম মৌসুম। গোল সংখ্যায় রাউলকে ছুয়ে ফেলেছেন। সামনে শুধুই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেটা যদি কোনদিন ধরা নাও হয়, এসিস্ট সংখ্যায় বেনজেমার সামনে যে কেউ নেই, শুধু এটাই রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে অমর আর অক্ষয় করে রাখতে পারত বেনজেমাকে। বেনজেমা যদি সুস্থ থাকেন তাহলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে মাঠে নামার বিচারে এই মৌসুমেই সান্তিলানা আর সামনের মৌসুমে সার্জিও রামোসকেও ছাড়িয়ে যাবেন তিনি হেসে খেলেই। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সর্বোচ্চ উয়েফা সুপারকাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপে নামা, বিদেশি খেলোয়াড় হিসাবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা এই ধরনের রেকর্ডে বেনজেমা তো আছেন ই, সাথে বলে রাখা ভালো রাউল, সান্তিলানা, হেন্তো, পিরি বা বুয়েত্রাগানোর চেয়ে গোল করার নিয়মিত মুখ হিসাবে বেনজেমা কিন্তু অনেক খানি আগানো।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলে ব্যালন ডি অর জেতা খেলোয়াড় আছেন ৭ জন। সব মিলে সাদা জার্সিধারী কেউ ব্যালন ডি অর জিতেছেন ১১ বার। ব্যালন ডি অর জেতা এবং রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলা খেলোয়াড় আছেন ১০ জন। এখন শুধু অক্টোবর মাসের অপেক্ষা যেখানে করিম বেনজেমা ঢুকে যাবেন এই অমরত্বের ডাক শুনতে পাওয়াদের তালিকাতেও। এই যে এত এত এওয়ার্ড, পুরষ্কার আর আলোচনা, সব ছাপিয়ে করিম বেনজেমা কেন কিংবদন্তী হয়ে থাকবেন জানেন?
করিম বেনজেমা প্রমাণ করেছেন- এভাবেও মন জয় করা যায়। এভাবেও ফিরে আসা যায়।
করিম মোস্তফা বেনজেমা- রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তী।
_____________________________
আসিফ হাসান জিসান।
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক।
ঢাকা, বাংলাদেশ