ডেভিড ব্যাকহাম: ফুটবলের মুকুটহীন রাজা

আমি যখন ক্লাস টু – থ্রিতে পড়ি তখন আমাদের বাসা ছিল মিরপুরে। সেইই ১৯৯০ এর আগের কথা।ফুটবল ছিলো তখন আমাদের প্রাণের খেলা। দিনে একবার তো বটেই কোনো কোনো দিন দুবার ও খেলতাম।বৃষ্টি যেনো আমাদের ফুটবল উৎসব হয়ে ধরনা দিতো।বৃষ্টি মানেই দিনে দু’বেলা ফুটবল। তখন আমি অবশ্য ডিফেন্সের খেলোয়াড় ছিলাম। আমাদের এলাকার কিছু বড় ভায়ের সাথে খেলার সুযোগও পেয়ে যেতাম মাঝেমধ্যে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো যারা ফার্স্ট ডিভিশন বা পাইনিয়রে খেলতো। আমাদের লাইনের আমরা ছিলাম এলাকার একটি আনবিটেন দল।অনেক সিল ও ভিউকার্ড জিতেছিলাম তখন। কখনো কোনো বাজির ম্যাচে হেরেছি বলে মনে পড়ে না। প্রায়শই অসময়ে এই ফুটবল খেলার জন্য মা বাবার কাছে অনেক বকাও খেয়েছি।
যাই হোক, একসময় বাবার ট্রান্সফারের জন্য চলে যাই ঢাকা থেকে সুদূর চট্টগ্রামে। সেখানে আমি হঠাৎ নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম।আস্তে আস্তে সেখানে গড়ে উঠে নতুন সার্কেল তবে তারা ছিলো ক্রিকেটের পোকা। তাই মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে ক্রিকেট খেলতাম। ১৯৯৭ এর আগে বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রামই ছিলো ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা। আকরাম নান্নু থেকে শুরু করে এক সময় অনেক ক্রিকেটার এসেছিল এই চট্টলা থেকে।
এবার আসি মূল টপিকে, কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কি ফুটবল পারি কিনা? আমি বলবো হুম, আমি ডেভিড ব্যাকহাম এর মতো ফুটবল খেলতে পারি। প্রিয় ভাইয়েরা আমার সম্পূর্ণ কথা না শুনে কেউ রাগ করবেননা। আমি আসলে ফুটবল খেলার সাথে অনেক বছর যাবত অনিয়মিত হয়ে পরেছি। তাই আমি মনে করি কি বল আমার কাছে আসবে আর আমি সেই বল রিসিভ করে নেক্সট কিক টা দিবো পাসের উদ্দেশ্যে। আর যারা আমার মতো অনিয়মিত ফুটবলার তারা এই থিউরিটা এপ্লাই করলে বুঝবেন ফুটবল আসলেই অনেক ইজি একটা খেলা। আমি এই ইজি থিওরি টা রপ্ত করতে চেষ্টা করেছি আধুনিক ফুটবলে জ্যামিতিক পাস ও ফ্রি কিকের রাজা ডেভিড ব্যাকহাম থেকে।
ডেভিড ব্যাকহাম দেখিয়ে গেছেন ফুটবল একটা সহজ খেলা এবং এই সহজ খেলার স্টাইল দিয়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়া যায় অনন্য এক উচ্চতায়। তবে ফুটবলে আরেকটা জরুরি বিষয় থাকা লাগবে,আর তা হল শারিরীক ফিটনেস। যা ডেভিড ব্যাকহামের অসম্ভব রকমের ছিলো। এই ইংলিশ রাজ পরিবারের লিজেন্ড শিখিয়েছেন যে ফুটবল একটা অভিজাত খেলা যা দিয়ে আপনি সব খেলার আভিজাত্যকে বিট দিতে পারবেন।
আজ এমনই এক রাজার গল্প আপনাদের কাছে তুলে ধরবো। পৃথিবীতে কিছু মানুষ রাজা হওয়ার জন্যে জন্মায়। ডেভিড ব্যাকহাম হলেন তেমন একজন মানুষ। তিনি শুধু ফ্রিকিকেই বিশ্বসেরা ছিলেন না, দলের প্রয়োজনে তিনি ঠিকই সময়মত জ্বলে উঠতেন। পুরো নাম ডেভিড রবার্ট জোসেফ ব্যাকহাম! অসাধারণ প্রতিভাবান একজন ইংলিশ ফুটবলার।তিনি তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের অনুর্ধ্ব ১৮ ফুটবল টিমে খেলে। অতঃপর ১৯৯৩ সালে তিনি খেলা শুরু করেন ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড এর হয়ে এবং জাতীয় দলে নিজের জায়গা করে নেন ১৯৯৬ সালে।
১৯৭৫ সালের ২রা মে লন্ডনে ডেভিড এডওয়ার্ড অ্যালেন ব্যাকহাম এবং সান্দ্রা জর্জিনা ওয়েস্টের ঘরে জন্ম নেন ব্যাকহাম। নাম রাখা হয় রবার্ট জোসেফ, পিতার নাম যোগ হয় আগে এবং পরে। সেই টাইটেলেই পরিচিত হন এই জীবন্ত কিংবদন্তী।তার বাবা মা ছিলেন ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একনিষ্ঠ ভক্ত। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সব ম্যাচেই তাদের উপস্থিতি ছিল নিশ্চিত।আর মুলত তখন থেকেই রেড ডেভিলদের প্রতি একটা টান জন্মায় ব্যাকহামের মনে। ফুটবলের প্রতি তার ভালবাসা এতটাই বেশি ছিলো যে স্কুল শিক্ষক যখন তাকে প্রশ্ন করেছিল তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? তখন তিনি বলেছিলেন- আমি ফুটবলার হতে চাই। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তুমি পেশা হিসেবে তুমি কি বেছে নিতে চাও?তিনি  বলেছিলেন, এটাই একমাত্র জিনিস যা আমি হতে চাই।
ব্যাকহাম যখন ছোট ছিলেন তখন বাড়ির পেছনে একদিন ফুটবলকে বাঁকিয়ে দারুণ এক কিক মারেন সেদিনই যেনো তিনি একজন তারকা হয়ে যান। চার বছর বয়সী এক ছেলের এমন শট প্রতিবেশীরা দেখে বেশ প্রশংসা করেছিলেন। সেই থেকেই বোধয় তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা।
ফুটবলের প্রতি টান থেকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড লিজেন্ড ববি চার্লটনের একটি ফুটবল স্কুলে ভর্তি হন। আর সেখানেই সুযোগ মেলে ফুটবল ক্লাব বার্সার ট্রায়ালে অংশ নেয়ার। কিন্তু বার্সা হয়তো এই রত্নকে তখন সঠিকভাবে চিনতে সক্ষম হয়নি। সেখান থেকে ব্যর্থ হলেও ইংলিশ ক্লাব টটেনহাম ঠিকই চিনে নেয় বালক ব্যাকহামকে। ১৯৯০ সালে তিনি অনূর্ধ্ব-১৫ প্লেয়ার অফ দি ইয়ার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে যোগদান করেন ম্যান ইউনাইটেড এর ইয়ুথ ক্লাবে। তখন গিগস স্কোলস’রা ছিলেন তার সতীর্থ। ১৯৯৩ সালের সামারে প্রফেশনাল প্লেয়ার হয়ে সাইন করেন ম্যান ইউনাইটেডে। কিন্তু এত তরুণ খেলোয়াড় হয়ে একাদশে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিলনা তার জন্য। তাই এক বছরের জন্য লোনে যান তিনি।
১৯৯৫ সালেই আবার ফিরে আসেন।সে মৌসুমে সুযোগ পান ৪ ম্যাচে। ব্যাকহামকেকে প্রধান একাদশে সুযোগ না দেয়ার মূল্য সেবার দিতে হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। এফ এ কাপের ফাইনালে তাকে স্কোয়াডেই রাখা হয়নি আর ইউনাইটেড হেরেও যায় সে ম্যাচে। তখনই ইউনাইটেড এর বস স্যার ফার্গুসন পরের মৌসুমে প্রাধান্য দিতে শুরু করেন তরুণদের।
অচিরেই দল ঘুরে দাড়ায় আর ব্যাকহামের তুখোড় নৈপুণ্যে ম্যান ইউনাইটেড ইপিএল জিতে। পরের বছর ১৯৯৬ সালে ব্যাকহাম সুযোগ পান জাতীয় দলে। সে বছরের আগস্টে মাঝমাঠ থেকে গোল করে বিশ্বকে অবাক করে দেন। এরিক ক্যান্টনারর বিদায়ে ১৯৯৭ সালে পান ম্যান ইউনাইটেড এর  সবচেয়ে জনপ্রিয় ৭ নাম্বার জার্সি। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে জিতে নেন ট্রেবল। বিশ্ব তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল ব্যাকহামের দিকে।
পরবর্তীতে তিনি ব্যালন ডি অ’রে নমিনেশন পেয়ে দ্বিতীয় সেরা হন। ২০০০-০১ সিজনে টানা ৩য় বারের মতো লিগ জেতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ ঘটনা ছিল এটি।
স্যার ফার্গুসন একসময় তার মিডিয়ায় বাড়াবাড়ির জন্য ২০০৩ মৌসুমে বেঁচে দেন রিয়াল মাদ্রিদে রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট পেরেজ তাকে ৩৫ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফি দিয়ে কিনে আনেন রিয়াল মাদ্রিদে। পেরেজ ঘোষণা দেন নতুন ইতিহাস গড়বেন ব্যাকহাম। দলে তার আগমনেই পূর্ণতা পেয়েছিল গ্যালাকটিকোরা। রোনালদো, জিদান, ব্যাকহাম, রাউল, কাসিয়াস, কার্লোস, ফিগো কে ছিলনা সেই দলে!
২০০৩ সালে রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবটি ৬০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ফুটবলকেন্দ্রিক ব্যবসা করেছে। তার কারনে লাভ ১৩৭ শতাংশ বেড়ে যায়। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন লিগ শিরোপা। পরে সেখান থেকে যান লস এঞ্জেলসের এলএ গ্যালাক্সিতে যোগ দেন।ফ্রান্সের ক্লাব পিএসজিতে এসে সেখান থেকেই অবসর নিয়ে নেন।
জাতীয় দলের হয়ে ব্যাকহাম, ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বেকহ্যাম মোট ৫৮টি খেলায় ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে দলের হতাশাজনক নৈপুণ্যের পর তিনি অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
তার সবচেয়ে বড় পরিচিতির অন্যতম কারণ তার জাদুকরি ফ্রি কিক এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল নিজস্ব জীবন। ২০১৩ সালে অবসর নেওয়ার পরও ফোর্বস তালিকায় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অবসরে যাওয়া খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। দশ বছর যাবৎ ইউনিসেফের অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তি এবং দারুণ সব বিজ্ঞাপন করে ব্যাকহাম ফুটবল জগতের বাইরে ফ্যাশন জগতেও অনেক জনপ্রিয়। স্টাইল আর দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দিয়ে জয় করেন অসংখ্য ভক্ত সমর্থকের মন, তাইতো ব্যাকহ্যাম মানেই নতুন এক উন্মাদনার নাম।

অর্জন

ক্লাব-
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-
এফএ যুব কাপ: ১৯৯২
প্রিমিয়ার লিগ: ১৯৯৫–৯৬,১৯৯৬–৯৭,১৯৯৮–৯৯, ১৯৯৯–২০০০,২০০০–০১,২০০২–০৩.
এফএ কাপ:১৯৯৫–১৯৯৬,১৯৯৮-৯৯
এফ এ কমিউনিটি শিল্ড:১৯৯৬,১৯৯৭
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ: ১৯৯৮-৯৯
আন্তঃমহাদেশীয় কাপ:১৯৯৯
রিয়াল মাদ্রিদ –
লা লিগা: ২০০৬–০৭
সুপারকোপা দে এস্পানা: ২০০৩
এলএ গ্যালাক্সি-
এমএলএস কাপ: ২০১১, ২০১২
ওয়েস্টার্ন সম্মেলন (নিয়মিত মৌসুম): ২০০৯, ২০১০, ২০১১
ওয়েস্টার্ন সম্মেলন (প্লে অফ): ২০০৯, ২০১১, ২০১২
সমর্থকদের সিল:২০১০,২০১১
প্যারিস সেন্ট জার্মেইন –
লিগ ওয়ান: ২০১২–১৩
ইন্ডিভিজ্যুয়াল-
২০০১ ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় রানার-আপ ট্রফি।
ব্যালন ডি অর রানার আও-১৯৯৯
পিএফএ বর্ষসেরা তরুণ খেলোয়াড়: ১৯৯৬-৯৭
ইংল্যান্ডের বর্ষসেরা খেলোয়াড়: ২০০৩
উয়েফা ক্লাবের বর্ষসেরা ফুটবলার:১৯৯৮-৯৯
উয়েফা ক্লাবের বছরের সেরা মিডফিল্ডার:১৯৯৮-৯৯
ইউএএফএ বর্ষসেরা দল: ২০০১, ২০০৩
প্রিমিয়ার লিগ ১০ মৌসুমে পুরষ্কার:১৯৯২-৯৩  থেকে ২০০১-০২
বিবিসি স্পোর্টস বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব: ২০০১
বিবিসি স্পোর্টস পার্সোনালিটি অফ দ্য ইয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড: ২০১০
রিয়াল মাদ্রিদ বর্ষসেরা খেলোয়াড়: ২০০৬-০৬
পিএফএ বর্ষসেরা দল:১৯৯৬-৯৭,১৯৯৭-৯৮,
১৯৯৮-৯৯, ১৯৯৯-২০০০ প্রিমিয়ার লিগ।
ফিফা ১০০ জনের লিস্টে
শতাব্দীর পিএফএ দল :১৯৯৭-২০০৭
আন্তর্জাতিক ফুটবলের ইতিহাস ও পরিসংখ্যান ফেডারেশন (আইএফএফএইচএস) কিংবদন্তী
ইউইএফএ রাষ্ট্রপতির পুরষ্কার: ২০১৮
দ্য কুইন এলিজাবেথ II: ২০০৩ দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্ডার অফ অফিসার।
জাতিসংঘের শিশুদের তহবিল (ইউনিসেফ) শুভেচ্ছাদূত (২০০৫-বর্তমান)
“ব্রিটেনের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূত” – ১০০ গ্রেট ব্রেস্টন পুরষ্কার
সেলিব্রিটি ১০০ জনের মধ্যে ১৫ নাম্বার.
 ফোর্বস; ২০০৭
যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের কম বয়সী ৪০ জন প্রভাবশালী পুরুষদের তালিকায় ১ নাম্বার।
অ্যাথলেট অ্যাথলেট অ্যাওয়ার্ড; ২০১১
(লেখাটি লেখক কর্তৃক স্পোর্টস প্রতিদিন প্লাটফর্মে পূর্বে প্রকাশিত)

You May Also Like