মহাবিজয়ের বজ্রনিনাদ

বাংলায় বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে- “বজ্র এক জায়গায় দুইবার পড়ে না”। এই প্রবাদটি যিনি লিখেছেন এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের রিয়াল মাদ্রিদকে দেখলে লেখাপড়ার ঝামেলা বাদ দিয়ে নিশ্চিত সন্ন্যাসব্রত নিয়ে নিতেন। এই রিয়াল মাদ্রিদ যেন অলিম্পাস পর্বতের মাথা থেকে নেমে আসা জিউসের বজ্র, যেন নর্ডিক মিথলজির থরের হাতুড়ি মিলনির। ম্যাচ শুরুর আগে এই দলের কোচ এসে একাদশ, ফর্মেশান, গোপন খবরাখবর সব বলে দিয়ে যান। এক লেগ খেলার পরে প্রতিপক্ষের মনে হয় তারাই জিতবে। কিন্তু শেষ বাশি বাজার আগে ঘুম ভাঙ্গে ইউরোপের রাজাদের। একবার নয় দুইবার নয়, তিন তিনবার খাদের কিনারা থেকে রিয়াল মাদ্রিদ ফিরে এলো মিলনিরের মত, প্রতিপক্ষের উপর অলিম্পাস পর্বতের মতই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর নির্মানাধীন স্ট্যান্ড থেকে নেমে এলো বজ্রপাত। একই ভাবে। একই জায়গায়। এ যেন অবধারিত, এ যেন নিয়তি, এ যেন দক্ষিণ ভারতের সিনেমার স্ক্রিপ্ট যেখানে নায়ক শেষ দৃশ্যে জিতে যাবেই যাবে।

গত লেগে ৪-৩ গোলের ব্যবধানে সিটি জিতে থাকলেও আকাশে বাতাসে কানকথা ছিল এই যে রিয়াল সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে জিতেও যেতে পারে। ইংরেজ ফুটবল মানেই একরাশ ফাঁপা অহমিকার ছড়াছড়ি। সুন্দর ক্যামেরায় লীগ দেখানো হয়, কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢালছে তাদের দলগুলি দল সাজাতে। এ লিগের শীর্ষ ৫ এ থাকা কত কঠিন খুজলে এর বিস্তারিত বয়ান পেতে কষ্টও করতে হবেনা বেশি একটা। এখানে মিডিয়ার ক্ষমতা এতটাই যে তারা নিজেরা নিজেদের পছন্দের খেলোয়াড়কে পুরষ্কার দেয়, এমনকি মৌসুমে ৪২ ম্যাচে ৪২ গোল আর ১৩ এসিস্ট করা বেনজেমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্ন করে অন্য কাকে ব্যালন ডি অর জেতানো যায় এরকম প্রায় মাতাল লেখালেখিও পাওয়া যা চাইলেই। সেই দেশে কোচিং করান বলে গার্দিওলা যত বড় তাকে তার চেয়ে অনেক বড় মনে হয় ঠিকই, কিন্তু গার্দিওলা তো তর্কযোগ্যভাবে হলেও কারো কারো মতে তো বিশ্বের সেরা কোচ ই। 

৮৯ মিনিটে ৫-৩ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় সেই কোচের দলকে কেউ টাইটানিকের মত ডুবিয়ে দিয়ে যাবে এটা তার এত বিখ্যাত ফুটবল মস্তিষ্কও কোনভাবেই ধরতে পারেনি। ধরতে পারলে কেভিন ডি বুয়েন কিংবা রিয়াদ মাহরেজকে এত আগে হয়তো তুলে নিতেন না। কিন্তু এর পর ও গোললাইন থেকে মেন্ডি যখন জ্যাক গ্রিলিশের শট ফিরিয়ে দিলেন, কে ভেবেছিল রিয়াল এই ম্যাচ সেখান থেকেই খেলবে নতুন করে? তাও এমন সময়ে যখন প্রায় ৮০ মিনিট উজ্জ্বীবিত দলকে দেখাচ্ছে ম্রিয়মান, হতাশ এবং হাল ছাড়া নৌকার মত?

Real Madrid v Manchester City Semi Final Leg Two - UEFA Champions League

রড্রিগো গো’স এর দ্বিতীয় গোল। এগিয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ। (ছবিঃ Alvaro Medranda/Eurasia Sport Images/Getty Images)

গার্দিওলার পক্ষে ম্যাচের হাল ঘুরিয়ে দিয়েছিল গুন্ডোগানের বদলী হিসাবে নামা। আনচেলত্তির ম্যাচটা বদলে গেল তার দুই বদলী রড্রিগো আর কামাভিঙ্গার হাত ধরে। মনে করিয়ে দিই এই দুইজনের মিলিত বয়স লুকা মদ্রিচের চেয়ে মাত্র ২ বেশি। রড্রিগোর বাবার বয়স মদ্রিচের কাছাকাছি বলে ঠাট্টাচ্ছলে রড্রিগো তাকেই “বাবা” বলে ডাকেন। কিন্তু বাবার বদলী নেমে দুই ছেলের বয়সী তরুণ যে ফুটবলটা খেললেন, তাতে আগামী অনেকদিন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু যে তাদের ভালবাসবে সেটার পূর্বাভাস ছিল পুরোপুরি। রড্রিগোর নামের পাশে দুই গোল লেখা আছে। লেখা নেই যেটা তিনি নামার পরই দল গতি পেয়েছে ডান প্রান্ত ধরে। কামাভিঙ্গা তো রীতিমত তারকা হয়ে যাচ্ছেন প্রথম মৌসুমেই। যেভাবে বল নিয়ে তিনি দৌড়ান, পাস দেন কিংবা ম্যাচ পড়তে পারেন- সেটা রীতিমত ভয়াল এক সৌন্দর্য্য।

এই দুই তরুণের পায়ে চড়ে এল আজকের বজ্রপাত। ৮৯ মিনিটে ০-১ গোলে এগিয়ে সিটি যখন ৫-৩ গোলে লেগ জেতা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ৯৪ মিনিটে তারা হঠাত করে দেখল ম্যাচ তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে দুই তরুণ আর তাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে বেনজেমা আছেন অপেক্ষায়। এ যেন সিনেমার চিত্রনাট্য, এ যেন বিধাতার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা স্ক্রিপ্ট এ যেন শ্যুটিং করে সেলুলয়েডের পাতায় ধরে রাখা থ্রিলার। 

আনচেলত্তি এই মৌসুমে যেভাবে প্রথম একাদশ দিচ্ছেন তাতে প্রথমার্ধে কেন যেন দল ভাল খেলতে পারছে না এবং এই কারণেই বারে বারে ভিনিসিয়াস-বেনজেমার সাথে বদলী খেলোয়াড়েরা এগিয়ে আসছেন ম্যাচ বদলে দিতে। এই ম্যাচে আগে গোল খেয়ে গেলেও রিয়াল মাদ্রিদ ই ছিল ম্যাচের বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণে। ভিনিসিয়াস মাথাটা ঠান্ডা রাখতে পারলে আর বেনজেমা স্বভাববিরুদ্ধ দু চারটা মিস না করে বসলে ম্যাচ শেষ হয়ে যায় প্রথমার্ধেই। সিটি বেশ কিছু ভাল আক্রমণ করেছে দ্বিতীয়ার্ধে। কিন্তু এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচ মানেই ঘুমন্ত দৈত্যের জেগে উঠে পিষে ফেলার যে প্যাটার্ন- তার শিকার হল তারাও। এই জয় গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কারণে।

চ্যাম্পিয়ন্স লীগের নক আউট পর্বে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড ছুয়ে ফেলেছেন করিম বেনজেমা। (ছবিঃ Getty Images)

মনে রাখুন এটা গত ১২ বছরে রিয়াল মাদ্রিদের ১০ম সেমিফাইনাল এবং ৫ম ফাইনাল। দলে ভাঙ্গাগড়া, রাজনীতি কিংবা কোচ বদলের মত হাজারো প্রশ্ন থাকলেও দলটা যে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে দুর্দান্ত একটা মানসিকতা নিয়ে আসে, শুধু এজন্যই আপনি এ দলটার ব্যানার হাতে গলা ফাটাতে পারেন। কাউকে যদি বলতে শোনেন “ এ শুধুই ভাগ্য” তাকে দু চারটে বাঁকা কথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হবার ও আপনার কোনই কারণ নেই। করিম বেনজেমার এই মৌসুমের পরিসংখ্যান দাড়াচ্ছে ৪৩ ম্যাচে ৪৩ গোল এবং ১৪ এসিস্ট। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ১১ ম্যাচে ১৫ গোল এবং ২ এসিস্ট। নক আউট পর্বে ১০ গোল যেটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিশ্বরেকর্ডের সমান (এবং আরো একটি ম্যাচ হাতে রয়েছে)। গোল করেছেন টানা ৫ ম্যাচে যেটা আর এক ম্যাচ বাড়াতে পারলে ছোয়া হয়ে যাবে রোনালদোর আরেকটি রেকর্ড। সুপারকোপা এবং লা লীগা জয়ের পর চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের অত্যন্ত কূলীন শীর্ষ ৫ এর বিপক্ষে এই মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পরের নামটা তাদের বিপক্ষে ৭ গোল করা করিম বেনজেমা। এখানে মজার বিষয়টা হচ্ছে করিম বেনজেমা ইংল্যান্ডে খেলেন ই না। তাই ব্যালন ডি অর জয়ের ব্যাপারে ফাঁপা ইংরেজ মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা শুনলে হাহা রিয়াক্ট বাটনটা চাপতেও আর আপনার সংকোচ করার কোন সুযোগ নেই।

সবশেষে কার্লো আনচেলত্তি। এটা সত্য যে এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ যা করছে তা ট্যাকটিকাল কোন বিপ্লব নয়। আনচেলত্তি সেটা খুব ভাল করেই জানেন। কিন্তু আনচেলত্তি তার গোটা ক্যারিয়ারে যা করে এসেছেন চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের নিয়ে, ক্যারিয়ারের শেষ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেটা তিনি করে দেখাচ্ছেন ১৮-২২ বছর বয়সী একদল তরুণদের নিয়ে। লুকা মদ্রিচ বা করিম বেনজেমাদের পিছনে মশাল হাতে একদল তরুণ যখন বিজয়ের মিছিল করছেন, তাদের উপর আমরা ভরসা পাচ্ছি। এই ভরসা এই আস্থা যে একদল সদ্য টিন এজ পেরুনো তরুণের উপর তৈরি করা গেছে, তার জন্য আনচেলত্তি শুধু ধন্যবাদ নয়, পাবেন প্রাণখোলা ভালবাসা। ট্যাকটিক্স ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু বিশ্বাস তার চেয়ে বড় অস্ত্র যখন আপনি ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলবেন। কার্লো এই বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিয়েছেন। আবারো মনে করিয়ে দিই, এটা কার্লো আনচেলত্তির রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসাবে তৃতীয় মৌসুম যেখানে তিনি দুইবার দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে নিয়েছেন। যে মৌসুমটাকে আমরা “খারাপ” বলি সেটাতেও তার দল সেমিফাইনালে হেরেছে এক গোলের ব্যবধানে। তাই কোচ হিসাবে গার্দিওলা, টুখেল কিংবা পচেত্তিনোর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ভাবার আগে মনে রাখুন বুড়ো কার্লো আনচেলত্তি এদের একই মৌসুমে বাড়ির পথ দেখিয়েছেন এমন এক দল নিয়ে, যাদের চেয়ে আয়াক্সের ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের সম্ভাবনা বেশি বলে মৌসুমের শুরুতে মন্তব্য করা হয়েছে ইউরোপ জুড়ে।

পরিশেষে, প্যারিসে রিয়াল মাদ্রিদ যখন লিভারপুলের সামনে দাঁড়াবে, আমরা আবারো হয়ে যাব আন্ডারডগ। হয়ে যাব “ভাগ্যবান”, হয়ে যাব “ দূর্ঘটনা”। ইংরেজ সংবাদমাধ্যম লাল জার্সি পড়া যাকে তাকে ব্যালন ডি অর দিয়ে দেবে, কার্লো আনচেলত্তির ট্যাকটিক্সে ছিদ্র বের করবে শত শত। হয়তো আপনাকে মনে করিয়ে দেয়া হবে ক্লপ কত দূর্দান্ত কোচ, কত অসাধারণ লিভারপুল খেলোয়াড়েরা। হয়তো সুযোগে মনে করিয়ে দেবে ২০১৮ সালের “প্রতিশোধ” এর গল্পগাথাও। এসব জনমানুষ পড়তে পছন্দ করে। রিয়াল মাদ্রিদকে হারবে বললে সেই খবরের কাটতি বাড়ে। কিন্তু আপনি রিয়াল মাদ্রিদের জার্সির দিকে তাকিয়ে শুধু দুইটি জিনিস ভাববেন। প্রথমত, যে জার্সিতে ১৩ টি শিরোপার সম্মান একে রাখা আছে, ১৪ তম শিরোপার সামনে দাঁড়ালে তাদের যদি কেউ আগেই হারিয়ে দিতে চায় তারা মনে মনে ভীত। আর দ্বিতীয়ত, এই মৌসুমের রিয়াল মাদ্রিদকে যারা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের পেছনে ছুটতে দেখেছে, তারা সবাই জানেন এই ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি।

_____________________________
আসিফ হাসান জিসান।
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক
ঢাকা, বাংলাদেশ।

You May Also Like