তথ্যের মুক্ত প্রবাহের যুগটা বড্ড নির্মম। ধরুন ফুটবল খেলাটা দেখতে বসলেন, বসে কাউকে ভাল লেগে গেল। আপনার মনে হল এই খেলোয়াড় বা এই দলটাই বিশ্বের সেরা। এই যুগে সেটা আপনি জনসমক্ষে বললেই চলবেনা। পরিসংখ্যান এবং সেটার অলিগলি ঘুরে সেটা যদি প্রমাণ দিতে না পারেন তাহলে আপনার আবেগটা একরকম মূল্যহীনই।
আপনার দল কোন প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি শিরোপা না জিতলে তাকে ওই প্রতিযোগিতার সেরা দল বলাটা বালখিল্য। সেরকমই খেলোয়াড় মাপতে এখন ব্যালন ডি অর, ফিফা দ্যা বেস্ট কিংবা অন্য কত শত নিক্তি রয়েছে সেটা গুণেও শেষ করা যায় না। কিন্তু সব সময় এভাবে ফুটবল দেখা যায় না। খেলাটা দিনশেষে আবেগের, আপনার মনের গহীন কোণ থেকে উৎসরিত উত্তেজনার এবং এবং আপনার যাকে ভাল লাগে তাকে আপনার ভালই লাগে। পরিসংখ্যান এই ভাল লাগার সামনে বড়ই বোকা। আর এই ভাল লাগাটা পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যখ্যাও করা যাবেনা। এর জন্য আপনার পছন্দের মূহুর্তটা আপনাকে সামনে থেকে দেখতে হবে। একসাথে ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে হবে সেই একই আবেগ।
রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক প্লাটফর্মে পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে কে আবগের জয়গান সে উত্তরটা একটু পরই আসছি। কিন্তু বলে নিই, ইউরোপ ও স্পেনের সফলতম দলের সমর্থক হিসাবে আমদের ছোট ছোট আবেগের অনেক অংশই ঢাকা পড়ে যায় পরিসংখ্যানে সেরা হবার সাফল্যের উদযাপনে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা মাঠের ছোট ছোট মুহুর্তগুলি তরিয়ে তরিয়ে উপভোগ করি না। কিংবা মাঠের মুহুর্তের জাদু আমাদের উদ্বেলিত করে না।
যার কথা লেখা নিয়ে এত বড় সূচনা, তিনি পরিসংখ্যানেও তার প্রজন্মের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার। একজন আধুনিক ল্যাটিন ফুটবলারের পক্ষে জেতা সম্ভব এমন শুধু একটা শিরোপাই তার ক্যাবিনেটে নেই। কোপা আমেরিকা। সেটাও যতটা তার দায়, তার চেয়ে বেশি ব্রাজিলিয়ান ফেডারেশানের যারা কোপা আমেরিকাতে দ্বিতীয় সারির দল খেলিয়েও দুইটি শিরোপা জিতে ফেলায় কখনো তাঁর মত প্রজন্মান্তরে জন্মানো প্রতিভাকে কোপা আমেরিকা খেলানোর প্রয়োজন ই মনে করেনি। এর মধ্যে ব্রাজিলের বর্ষসেরা হয়েছেন একবার, ইটালিতে দুইবার। ব্যালন ডি অর জিতেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স লীগে মিডফিল্ডার হিসাবে ১০ এর বেশি গোল করার কীর্তিও দেখিয়েছেন।
কিন্তু রিকার্ডো আইক্যাজসন ডস স্যান্টোস লেইতেকে মানুষ যতটা মনে রেখেছে তার প্রজন্মের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হিসাবে, তার চেয়ে বেশি মনে আছে মেসি-রোনালদো যুগের আগের শেষ সেরা খেলোয়াড় হিসাবে। ফুটবল পরিসংখ্যানের বিচারে কি স্বাভাবিক আর কোনটা নয় এটা মেসি রোনালদো পুরোপুরি নতুন করে লিখেছেন। এই কারণেই প্রায় স্বর্নালী ক্যারিয়ার কাটানো পর ও কাকাকে মনে রাখতে হচ্ছে তার ক্যারিয়ারের জাদুকরী মূহুর্তগুলির জন্য।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিশ্বসেরা ডিফেন্সকে বশীভূত করেছিলেন সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। via GIFER
আর রাখবেন নাই বা কেন? নিজের ডি বক্স থেকে চিরপ্রতিদ্বন্দী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বল টেনে নিয়ে যিনি প্রতিপক্ষের সবাইকে ঘোল খাইয়ে গোল করেছেন কিংবা ওল্ড ট্রাফোর্ডে রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ধ্বংস করে দিয়েছেন একাই, কিংবা দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে দলের প্রায় সবগুলো গোলের শেষ পাস যার পা থেকে এসেছে তাকে মনে রাখতে এই মুহুর্তগুলি কম কীসে?
কাকাকে নিয়ে যারাই লেখেন সবাই কিছু জিনিস গতবাধার মত লিখে ফেলেন। কীভাবে ফুটবল খেলার ই কথা ছিল না তার। কীভাবে তিনি যতটা ল্যাটিন তার চেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান, তিনি কতটা ধার্মিক কিংবা ইনজুরি আর মরিনহো তার ক্যারিয়ারকে কীভাবে শেষ করে দিয়েছেন। কিন্তু খেলোয়াড় কাকাকে নিয়ে যে জিনিসটা একদমই লেখা হয় না, সেটা হছে ব্রাজিলের তিন বিখ্যাত R এর দুইজন উত্তরসুরী ছিলেন। তাদের মধ্যে তিনিই শুধু নিজের প্রত্যাশার সেরা পর্যায়ে পৌছাতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রাজিলের রাজপুত্র। ১০ নাম্বার জার্সি চাপিয়ে যিনি ব্রাজিলকে আর একটি ধাপ উপরে নিয়ে যেতে নিজের হাটু থেকে হৃদয় সব বন্ধক রেখেছিলেন ভাগ্যবিধাতার কাছে। ২০১০ বিশ্বকাপটা না খেলে ছুরির নিচে গেলেই হয়তো ক্যারিয়ারটা লম্বা হত আরো। হয়তো ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারতেন আরো অনেকদিন। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তাকে মুকুট পরাবেন একটা ঝলকের মত, সেই ঝলকে ঝলসে যাবে একটি প্রজন্মের চোখ, একদল কিশোরের আইডল হবেন তিনি। কিন্তু তাকে নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠবেনা। তাঁকে নিয়ে পরিসংখ্যানের বাগাড়ম্বর হবেনা। কিন্তু তাকে সব কিছুকে বোকা করে রেখে একদল তরুণ ভালবেসে যাবে।
ল্যাটিন সুপারক্লাসিকোতে কাকা-মেসি দ্বৈরথে অনেকদিন কাকাই ছিলেন আসরের মধ্যমনি। ছবিঃ Diario AS
কাকা এসি মিলানের জার্সি খুলে যেদিন আকাশ পানে তাকিয়েছিলেন- সেদিনও হয়তো তিনি চেয়েছিলেন অতটুকুই। তাই ম্যানচেস্টার সিটির ব্ল্যাংক চেক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এসি মিলানে থাকতে। কিন্তু পরে যখন রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি যখন গায়ে চড়াবেন তিনি সেটা হবে ফি এর বিশ্বরেকর্ড। তারপর এক সপ্তাহের মাথায় সে রেকর্ড ভেঙ্গেও যাবে। কাকা রিয়ালের হয়ে ধুকে ধুকে ফিরবেন- এসব গল্প এসব ট্রাজেডি সবার জানা।
কিন্তু আবার জানা কিন্তু মনে না রাখা কিছু বিষয় মনে করিয়ে দিই- ৫ বছরের রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে যখনই ডাক পেয়েছে দলের জন্য দিয়েছেন সবটুকু। ১২০ ম্যাচে ২৯ গোল এবং ৩৯ এসিস্ট অনেক আধুনিক মিডফিল্ডারের জন্য ঈর্ষার কারণ হতে পারে। কিন্তু যারা তাঁকে খেলতে দেখেছেন এবং ভালবেসেছেন- তাদের অপূর্ণ নিশ্বাসের কারণ একটাই। তিনি যে আরো কত বেশি পাবার যোগ্য ছিলেন। কাকার রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ার আপনি মনে রাখতে পারেন এপোয়েল নিকোশিইয়ার, ভিয়ারিয়াল বা এটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে তার জাদুকরী গোলগুলি থেকে। মনে রাখতে পারেন চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালে রোনালদোর পরের পেনাল্টিটা নিতে গিয়ে বল জালে জড়াতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া থেকে কিংবা মনে রাখে পারেন তার ভূবন ভোলানো হাসির সাথে যেটা দেখলে মনে হত- হোক ইনজুরী আর হোক কোচের অপছন্দ- লোকটা উৎরে যাবেন। উৎরে যাবে রিয়াল মাদ্রিদ ও।
কাকা একদিন স্বরুপে ফিরবেন- এই আশা বুকে নিয়ে টিন এজ এর সেরা সময়টা বুক বেধে কাটিয়ে দিয়েছে কত কিশোর। কাকা চেষ্টার কমতি করেননি কোনদিন। ২০১৪ সালে জাতীয় দলের মেন্টর সিনিয়র খেলোয়াড় হিসাবে যখন বিশ্বকাপে যাবেন এটা প্রায় নিশ্চিত, তখন ব্রাজিল মানো মেনেজেসকে বদলে নিয়ে এল স্কোলারিকে। মেনেজেসের মন জয় করতে তিন বছর শ্রম দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১০ এর বদলে ২০ নাম্বার জার্সিটা গায়ে দিয়ে ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলা আর হয়নি।
কাকার প্রতি ভালবাসার কারণ হিসাবে বলেছিলাম জাদুকরী মুহুর্তের কথা। বিশ্বকাপে ২০০৬ সালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জাদুকরী গোলের আগে মাত্র ২৩ মিনিট খেলে বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছিলেন ২০০২ সালে। ২০১৪ সালে দলে জায়গা না পেয়ে ফ্লোরিডার লালচে দিগন্তে ইতি টেনেছিলেন ক্যারিয়ারের। এর মাঝে এসি মিলানের হয়ে উঠেছিলেন চুড়ায়, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে অরলান্ডোতে দেখেছেন নিজের শেষ। কিন্তু যতই চড়াই উৎরাই পার হন, মুহুর্তের জাদু বাড়ুক বা কমুক, কাকা কখনোই ভালবাসা কম পান নি। এটাই হয়তো ইতিহাসের সেরা স্বীকৃত ত্রাকোয়াতিস্তার সবচেয়ে বড় জাদু। এই জাদু যারা দেখেছেন তাদের জন্য মেনে নেয়া কঠিনই হওয়া উচিত যে চিরতরুণ ব্রাজিলিয়ান এখন ৪০ এ পা দিয়েছেন। শুভ জন্মদিন রিকি। আপনি জানুন বা নাই জানুন, আমাদের মত একদল মানুষ জেনে বা না জেনে আপনাকে প্রচন্ড ভালবাসে।
_____________________
আসিফ হাসান জিসান।
মাদ্রিদ বেতার সম্পাদক ডেস্ক।
ঢাকা, বাংলাদেশ।