রিয়াল মাদ্রিদঃ আমরাই ইউরোপের রাজা

মৌসুমের শুরুটা একটু চর্বিতচর্বণ করি।

  • সুপারলীগ নামে এক প্রজেক্ট শুরুর আগেই ধরাশায়ী।
  • ইউয়েফার চোখ রাঙানি।
  • পেরেজকে চাপ দেয়া হচ্ছে সিভিসি ডিলে জয়েন করতে।
  • জিদান ও রামোসের (কিছুটা) তীক্ত বিদায়।
  • এমবাপ্পেকে আনার জন্য পিএসজিকে দেয়া প্রস্তাবনা নাকচ।
  • ভিনি জুনিয়র তখনো মাথামুণ্ডুহীন এক স্ট্রাইকার।
  • রাইট ব্যাকে কার্ভাহাল বাদে কেউ নেই।
  • রামোসের স্থান পূরণে আসছেন মেকশিফট লেফটব্যাক আলাবা।
  • বেল, মারিয়ানো, ইস্কোর মতো মরাকাঠ গুলো বিক্রি করাই গেলোনা।
  • রাইট উইং এ এসেন্সিও ইনজুরির পর আগের সেই ফর্মে নেই।
  • দলকে টানতে টানতে বেঞ্জেমা হাতের আংগুলের অপারেশন করাতেই পারছেন না।
  • সতীর্থদের সাথে হাংগামা জুড়ে দেবার জন্য বিখ্যাত সেবায়োস ফিরে আসছেন।
  • সান্ত্বনা হিসেবে শুধুই এক লা লীগায় আনকোড়া ফরাসি কামাভিংগা।
  • আর এইসব ছন্নছাড়া এক ঘর সামলাতে আসছেন ‘এভারটন’ ম্যান কার্লো আঞ্চেলোত্তি যিনি এর মাঝে একবার মাদ্রিদ হতেই বরখাস্ত হয়েছেন।

    চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো, খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে কি ভেবেছিলেন এই সিজনে মাদ্রিদ লীগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ডাবল জয় করবে?
    সংখ্যাটা জানিনা কত হবে কিন্তু অর্ধেকের এ পাশে হবার সম্ভাবনা অনেক কম।

    সিজনের শুরুতে আঞ্চেলোত্তি বেশ ভাল আগালেন কিন্তু তার সেই বিখ্যাত নন-রোটেশন পদ্ধতি আমাদের সেই পুরনো আঞ্চেলোত্তির কথাই মনে করিয়ে দিলো। মাঝে অক্টোবরে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে শেরিফের কাছে হোম ম্যাচে এক বেইজ্জতি এবং পরের ম্যাচেই এস্পানিয়লের কাছে হার, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মিলে লীগে ৩ ম্যাচে হার আর দুই ড্র, মার্চ এ বার্সেলোনার কাছে বার্নাব্যুতেই শোচনীয় পরাজয়…
মৌসুমের নিচু জায়গাগুলো ছিল সব হারানোর বেদনার মত (ছবিঃ মার্কা)

লীগ জয়ের পথে মাদ্রিদের রাস্তাটা রোলার কোস্টারের চেয়ে কম কিছু ছিলোনা। 

চ্যাম্পিয়ন্স লীগে শেরিফের সাথে হারের কথা তো আগেই বললাম। নক আউটে প্রতিটিতেই কোনো না কোনো এক লেগে হার। তবুও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠা। পিএসজির সাথে এওয়েতে হেরে, হোমে ১ গোল খেয়ে ১৫০ মিনিট পর্যন্ত যেখানে মাদ্রিদ ২-০ তে পিছিয়ে সেখানে ১৮০ মিনিট শেষে বেঞ্জেমার অতিমানবীয় হ্যাট্রিকে ৩-২ এ জয়। চেলসির সাথে প্রথম লেগ জিতে এলেও নিজেদের মাঠেই বুমেরাং হতে হতেও এল পাদ্রে মদ্রিচের ত্রিভেলা পাস এবং তাঁর সন্তানতুল্য রদ্রিগোর ভলিতে নতুন সঞ্জীবনী এবং আবারো বেঞ্জেমার হেডে বেঁচে ফেরা। সিটি ম্যাচের আগে তো গিলেই ফেলেছিলো ইংলিশ ফুটবল পন্ডিতরা। সেটাকে প্রমাণ করতে গিয়ে যেন চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে গোল খেয়ে পিছিয়ে যাওয়া। বেঞ্জেমার হাফ চান্স কাজে লাগানো, ফার্নান্দিনহোকে লজ্জার মালা পড়ানো ভিনির সেই ডামিতে গোল হলেও ম্যানচেস্টার হতে ১ গোলে পিছিয়ে ফেরা।

সিজনের শুরুতে ইএসপিএন চ্যাম্পিয়ন্স লীগের বরমাল্য কাদের হতে পারে সেই লিস্টে রিয়াল মাদ্রিদকে রাখেইনি। সেটা প্রমাণ করতেই যেন ৭৩ মিনিটে মাহরেজের গোলা ছুটে এলো কোর্তোয়ার বাঁপাশ দিয়ে যা আটকাতে পারলেন না এই দীর্ঘদেহী। মাঠ হতে দর্শক ফিরতে শুরু করেছে, ঈদের পরের দিনের খেলা বলে অনেকে স্ক্রিন অফ করে ঘুমাতেও চলে যাচ্ছে। কিন্তু, মাঠে মাদ্রিদের পতাকাবাহীরা যেন অন্য কিছু ভেবেছিলেন। রদ্রিগো নিজেও কী জানতেন সেদিন তিনি এমন কিছু করবেন যা তাঁকে অমরত্মের দিকে নিয়ে যাবে। ৯০ তম মিনিট আর ৯১ তম মিনিটে যখন দু-দুটো বল্লমের ফলা গেঁথে দিলেন সিটিজেনদের বুকে তখন বার্নাব্যু ফুঁসছে। টিভি স্ক্রিনের সামনে কি আমরাও ফুসছিলাম না? এরপর বার্নাব্যুতে গর্জন উঠেছে, মাদ্রিদ বাঘের মতো বুক চিতিয়ে লড়েছে আর পেট্রোডলারে কেনা রুবেন দিয়াজের ভুল থেকে আসা পেনাল্টি হতে বেঞ্জেমা কফিনে শেষ পেরেক টা ঠুকে দিলেন।

  
কিন্তু, ইংল্যান্ডের আরেক বন্দরের দলের হঠাৎ প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা জাগলো। এন্টি-মাদ্রিদ সমর্থক যারা চরম অধ্যবসায়ের সাথে সেই ‘রাউন্ড অফ ১৬’ হতে মাদ্রিদের বিপক্ষে ছিলেন তাঁদের সাথে যোগ দিলেন ফুটবল পন্ডিতেরা। কোয়াড্রপল হয়নি তো কী হয়েছে, ট্রেবল হবে… ট্রেবল হয়নি তো কী হয়েছে ডাবল হবে… এই মর্মে দীক্ষিত, যে ‘ফ্রম প্যারিস ডাউন টু টার্কি’ চ্যান্টিং এ ভরা থাকে যাদের গ্যালারি তাঁরা আবার প্যারিসে আসছে সেই পুরনো প্রতিপক্ষ মাদ্রিদকে হারাতে। ফাইনালের দিন মুহুর্মুহু আক্রমণে বেদিশা মাদ্রিদের দিশা হয়ে এলেন কোর্তোয়া যার অনেক হিসাব চুকানোর বাকি ছিলো। আর এরপর?


ডান প্রান্ত হতে উরুগুইয়ান ফেদে ভালভার্দে আর বাম প্রান্ত হতে ছুটে আসা ব্রাজিলিয়ান ভিনিসিয়াস জুনিয়র, হুনি কালাফাতের স্কাউটিং এর দুই তরুণ, যারা মাত্রই চ্যাম্পিয়ন্স লীগের প্রথম ফাইনাল খেলতে নেমেছেন তাঁরা ল্যাটিন নাচনে আরেক ল্যাটিন এলিসনকে ফাকি দিয়ে মহা কাঙ্ক্ষিত গোল ঢুকিয়ে দিলেন জালে। ১৪তম শিরোপা তখন মাত্র নিঃশ্বাস দূরে।

অবশেষে, একটা সময় মহাকাল থেমে গেলো। 
রেফারি টারপিনের বাঁশি জানিয়ে দিলো সেটা আর নিঃশ্বাস দূরত্বেও নয়।

কিন্তু মৌসুম শেষে আমরাই প্রায় সর্বজয়ী (ছবিঃ মার্কা)


ভেবে দেখুন।
একটা দল যেখানে বেঞ্জেমা, মদ্রিচ, ক্রুস, ক্যাসেমিরো, কার্ভাহাল, মার্সেলো, ইস্কো, বেল, নাচোর মতো ৯ জন খেলোয়াড় ৫ম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে এসেছেন সেখানে গোল এলো কিনা দুই আনকোড়ার মিলিত ফসলে। প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতলো ভিনিসিয়াস, রদ্রিগো, ফেদে ভালভার্দে আর কামাভিংগার মতো তরুণ তুর্কিরা।
মাদ্রিদ এর নিজেদের অধ্যায় শেষ করতে যাওয়া দুই সেনানী মার্সেলোর ক্রস হতে বেলের সেই বাইসাইকেল কিক হতে আসা গোল ২০১৮ সালে লিভারপুলের স্বপ্ন কেড়েছিলো। ২০২২ এ একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফেদে ভালভার্দের গতিময় ক্রসকে ফিনিশিং দেয়া ভিনিসিয়াস… মাদ্রিদের ব্যাটন ঠিক হাতেই কি যায়নি?

সেই ২০১৬ এর আরবেলোয়ার মতো বলতে হয় ‘যখন সবাই ভেবেছে আমরা শেষ, তখন আমরা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয় করেছি’।


পুরো সিজন জুড়ে ‘এই বুঝি গেলো’ ভেবে ভেবে হৃদপিন্ডের উপর চাপ দিয়ে যাওয়া মাদ্রিদ সমর্থকেরা এবার একটু স্বস্তি পাবেন। সারা বছর ডাগ আউটে মেন্টোস চিবিয়ে যাওয়া আঞ্চেলোত্তি হয়তো এবার ইবিজা বা মায়ামির বিচে শুয়ে আনন্দে চুরুট টানবেন। পিন্টাস হয়তো কপাল কুচকাবেন সিজনের আগে আবার দলকে ফিট কীভাবে করবেন।


আরেকটা সিজন শুরু হবে। শুরু হবে ৩৬ ও ১৫ এর জন্য।
মদ্রিচের ভাষ্যমতে ‘পাঁচটা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফি ভাল কিন্তু আমাদের আরো চাই’।

আসলেই তো। আমাদের আরো চাই।
এই আরো চাই বলেই এটাই রিয়াল মাদ্রিদ। 
Somos los reyes de Europa.
আমরাই ইউরোপের রাজা।

রাজাদের তো চাহিদার শেষ থাকা উচিতই নয়। 
সিজনের শেষ বারের মতো তাহলে আরেকবার হয়ে যাক,
Hala Madrid!
Y nada mas!

You May Also Like