কার্লোর সেকেন্ড সেমিস্টারঃ তীরে এসে তরী ডোবার ২০১৫, নাকি আরেকটা ২০১৪?

জিদানের বিদায়ের প্রাক্কালে সকল মাদ্রিদ সমর্থকেরা যতটা জিদানের বিদায়ে চিন্তিত ছিলো তার সাথে বেশি ভীত ছিলো পোস্ট-জিদান সময়ে ভালদেবেবাস কার বাঁশিতে কাঁপবে সেটা নিয়ে। বিশেষত ২০১৮ এর জিদানের ১ম ইনিংসের পরবর্তী ভরাডুবি তো স্মৃতির অল্প কতক পৃষ্ঠা আগেই লেখা। সেখানে কোভিডের ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ সময়ে তো মাদ্রিদকে একেবারে রাফখাতায় তুলে দেয়াটাই বাকি ছিলো। জিদানের ২য় ইনিংস দেখেই কিনা তা বলা মুশকিল তবে ইতালিয়ান দাদু কার্লো আনচেলোত্তি ফিরলেন এবং মোটামুটি রাজকীয় বেশেই ফিরলেন। মাদ্রিদ এখন কোপা দেল রে ও উচলের নক আউট স্টেজে। এবং লা লীগার পাইলট পজিশনে। (লেখাটি যখন লিখছি তখনো লীগে এলচে ম্যাচ শুরু হয় নি। অতএব, তখন পর্যন্ত পাইলট সিটে আসলে কত শক্তভাবে আছে সেটা লেখা পড়ার পরেই জেনে যাবেন।) আনচেলোত্তি অন্তত আধা সিজন বেশ ভালোই উতরে গেছেন। সেই বিষয়ে জিসানের চমৎকার একটা লেখা ইতোমধ্যে মাদ্রিদ বেতারে আছে। পড়ে নিতে পারেন।

এই আধা সিজনে যতটুকু তৃপ্তি না পাওয়া গেছে তা ঢেকুর তোলার আগেই গিলে ফেলতে হচ্ছে। কারণ সামনে কঠিন পরীক্ষা। সেই কঠিন পরীক্ষার আগে কী কী সমস্যা সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতে পারে তার একটা ছোট্ট প্রচ্ছদ আজকের এই লেখা।

আনচেলোত্তির প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো তার খোঁড়া স্কোয়াড। খোঁড়া অনেক দিক হতেই। একেক দিক হতে শুরু করি। প্রথমত, মাদ্রিদের রাইট সাইড কখনোই বেশ ভাল অবস্থায় ছিলোনা। অন্তত ২০১৪ এর পর হতে নয়ই। জিদান নিজের প্রথম মৌসুমে দুইদিককেই প্রায় সমান সমান গুরুত্ব দিলেও ধীরে ধীরে লেফট ওরিয়েন্টেড হয়ে যান। এটার কারণ যতটানা প্লেয়ারদের ঝোঁক, তাঁর চেয়ে বেশি ডান দিকের গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ারদের স্যানিটাসে ভ্রমণ (পড়ুন ইনজুরি)। ডান পাশে আমাদের দুই হেভিওয়েট স্টার্টার বেল রয়েছেন ‘ওয়েলস>গলফ>স্যানিটাস>মাদ্রিদ’-এ, অন্যদিকে কারভাহাল গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের সময় হয়ে যান ইঞ্জুরড। এসেন্সিও এসিএল ইনজুরি হতে ফিরে ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনো নিজের প্রাইমের ৬০% এও পৌছাননি। লুকাস ভাস্কেজ ঠ্যাকা সামলানোর প্লেয়ার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং তার থেকে এর বেশি চাওয়াটাও বোকামি। একই জিনিস রদ্রিগোর ক্ষেত্রেও খাটে। যেহেতু মিড সিজনে কেউই দলে আসছেনা সেহেতু এই রাইট সাইডের দুর্দশা কাটাতে হবেই বর্তমান স্কোয়াড দিয়েই।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো নির্দিষ্ট কিছু প্লেয়ারের অপ্রাপ্তিতা। বিশেষত, হ্যাজার্ড এলচের বিপক্ষে দুর্দান্ত গোল করলেও তার অতীত ইতিহাসের কারণে ঠিক কতদিন তিনি সুস্থ থাকবেন তা বলা মুশকিল। ইস্কোর হঠাৎ উঠতি ফর্ম কিছুটা আশা জাগানীয়া হলেও বেলের খেলার প্রতি নির্লিপ্ততা, ফর্ম এবং ইনজুরি বেশ হতাশাজনক। ফর্মহীনতা, ইনজুরি ও আগাম ৩ ম্যাচ নিষেধাজ্ঞায় মার্সেলো যেন ডেভিস কাপের মতো নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর মারিয়ানোর কথা বলাই বাহুল্য। ফলশ্রুতিতে, স্কোয়াডে অনেক ভারী ভারী নাম থাকলেও দিন শেষে প্রথম একাদশের বাইরে আনচেলোত্তির হাতে বেঞ্চে ভরসা করার মতো তেমন কেউই নাই। এবং এইখানেই তৃতীয় সমস্যা।

তৃতীয় সমস্যা হলো এই ক্লান্ত হয়ে যেতে থাকা স্কোয়াড। আনচেলোত্তি রোটেশানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তা তাঁর পাঁড় সমর্থক ও বলবেন না। তাঁর উপর ইনজুরিগ্রস্ত-ফর্মহীন প্লেয়ার নিয়ে তো আর রোটেশান সম্ভব না। এর ফলে দলের গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়াররা কোনো বিশ্রামই পাচ্ছেন না। এবং এর মাঝে যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার হঠাৎ করে দলের বাইরে থাকছেন তখনই শুরু হচ্ছে বিড়ম্বনা। এবং এটাই ৪র্থ সমস্যা।

এই চতুর্থ সমস্যার মূলে হলো বেঞ্জেমার উপর দলের অতি-নির্ভরতা। একটা সময় বেঞ্জেমাকে দু-চোখে দেখতে না পারা ব্যক্তিও এখন বেঞ্জেমা ব্যতীত দল কল্পনা করতে পারছেন না। যার প্রমাণ এলচে ম্যাচটাই। লুকা জোভিচ আবারো হারালেন নিজেকে, ভিনিও কানেক্টর কাউকে না পেয়ে পুরনো ফর্মে ফেরত। দলের গেইম প্লে ঠিক রাখার জন্য বেঞ্জেমার বিকল্প ও নেই। কিন্তু, এতদিন ন্যাশনালে ব্রাত্য থাকায় ন্যাশনাল উইন্ডোতে নিজেকে যতটা রিচার্জ করতে পারতেন যা এখন অসম্ভব। আনচেলোত্তিকে তাই ভাবতে হবে বেঞ্জেমার অভাবে কীভাবে দলকে পাড়ি দিতে হয়। এই ন্যাশনাল ম্যাচ হচ্ছে আমাদের ৫ম সমস্যা।

হঠাৎ করেই একসাথে ব্রাজিল ন্যাশনাল টিমে ভিনি, মিলিতাও, রদ্রিগো, ক্যাসেমিরোর ডাক পাওয়া ও সেই সাথে উরুগুয়ে টিমে ফেদের ডাক পাওয়াটা আসলে আনন্দের নাকি দুর্ভাগ্যের সেটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে সেই ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ পর্যন্ত। আবারো এথলেটিক ক্লাব বিলবাও এর সাথে ম্যাচ এবং এই সংকুচিত স্কোয়াড নিয়ে সেদিনই কোপা ডেল রে স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে যেতে পারে।

এবং সবার শেষ সমস্যা যেটা সেটা হলো কোভিড। ৪র্থ বছরে পা রাখা এই মহামারী কোভিড-১৯ এর সর্বশেষ সংস্করণ ‘ওমিক্রন’-এ যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁদের অনেকেই হৃদপেশির সমস্যায় ভুগছেন যার সর্বশেষ সংযোজন বায়ার্ন এর ডেভিস। মাদ্রিদ প্রথম থেকেই খেলোয়াড়দেরকে বায়োবাবলে থাকার ব্যাপারে খুব বেশি চাপ দেয় নি। সেটা হতে পারে মানসিক অবসাদ রুখতে অথবা স্পেনের সংস্কৃতির কারণে। কিন্তু সিজনের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কেউ যদি কোভিডাক্রান্ত হয় তবে তা দলের জন্য তো বটেই, নিজের জন্য ও ভাল না হতে পারে।

রামোস এর সাথে পুনর্মিলনীতে এবং মাদ্রিদের নেমেসিস মেসির উপস্থিতিতে পিএসজির বিপক্ষে যেকোনো কিছু ঘটে যাওয়াই স্বাভাবিক যেহেতু মাদ্রিদ স্পষ্ট ফেভারিট নয়। কিন্তু লীগ জয়ের ক্ষেত্রে শুধু পা না হড়কালেই হলো। এতলেতিকো, ভ্যালেন্সিয়াসহ সবাই ধুঁকছে। শুধু এক সেভিয়াই লীগ জয়ের দৌড়ে মাদ্রিদকে চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছে। মাদ্রিদের যে বড় চ্যালেঞ্জ তা হলো ছোট টিমের লো ব্লক ও এক রাতের ‘লেভ ইয়াশিন’রূপী কিপারদের বিরুদ্ধে জয়ের কৌশল বের করা। বিশেষত লীগ টেবিলের ৭ম স্থান থেকে শুরু করে নিচে যত ব্যাক-বেঞ্চার আছে সবার বিপক্ষে সর্বোচ্চ পয়েন্ট বের করে আনা জরুরি। আনচেলোত্তির উচিত লীগের দিকে চোখ রেখে বাকি সব কিছুকে বোনাস হিসেবে ভাবা। যদিও মাদ্রিদ মানেই সব কিছু জেতা।

আপাতদৃষ্টিতে পথ বড় বন্ধুর। জিদান যদি থাকতো তাহলে হয়তো ‘এস উনা ফিনাল’ বলে তুড়ি মেরে আমাদের চিন্তাকেই দূর করে দিতেন। কিন্তু তাঁর এক সময়ের গুরু ও সারথি কার্লো আনচেলোত্তি এবার কোন মাফিয়া কৌশল সাজাবেন তার অপেক্ষায়। ২০১৩-১৪ মৌসুমে হেভিমেটাল গিটারে লা দেসিমা জেতানোর পর নাপোলি, এভারটনে দোতরা বাজিয়ে ফের মাদ্রিদে ফিরে আসা আনচেলোত্তিকে প্রমাণ করতে হবে তিনি দোতরা বেসুরো বাজালেও হেভি মেটাল গিটার বেশ ভালোই বাজান। নতুবা ‘পাপা’ আবারো সেই পুরনো খড়গই চালিয়ে দেবেন তাঁর উপর।

আলা মাদ্রিদ!

Cover image from Reuters. 

You May Also Like