রিয়ালের আর্থিক খতিয়ান – মিথ বনাম বাস্তবতা

“Right now, things are different. I’m leaving because I feel the club no longer has the faith in me I need, nor the support to build something in the medium or long term”

রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠিতে জিনেদিন জিদান।

খেলোয়াড় বিকিকিনির বাজারে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রিয়াল মাদ্রিদের ‘Right now’ কী এমন হলো যে মধ্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প দাঁড় করাতে না পারার আক্ষেপে পুড়ে জিদানকে বিদায় নিতে হলো?কোভিডের ধাক্কা? পরিচালনা পর্ষদের অতি সতর্কতা? নাকি ক্লাবের সর্বেসর্বা প্রেসিডেন্টের একগুঁয়েমি?

মহামারীর দিনগুলোতে লস ব্ল্যাংকোসদের অর্থনৈতিক অবস্থা আদতে কেমন? কিছুদিন আগেই মাদ্রিদ গত মৌসুমের আর্থিক খতিয়ান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে কোভিড-আক্রান্ত, শিরোপা-বর্জিত ২০২০-২১ মৌসুমেও ৮৭৪,০০০ ইউরো মুনাফার মুখ দেখেছে স্প্যানিশ ক্লাবটি, যা পুরো ইউরোপে অল্প কয়েকটি ক্লাবই করে দেখাতে পেরেছে।

কিন্তু ক্লাবের অর্থনীতির বৃহত্তর তথা সার্বিক চিত্র পেতে হলে তুলনামূলক আলোচনার বিকল্প নেই। অর্থনীতির মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের স্থিতি কিংবা অস্থিতিশীলতার সাম্যক ধারণা এবং অবস্থান বুঝতে একই লীগে একই নিয়মের অধীনে পরিচালিত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার সঙ্গে তুলনায় আসা যাক।

গত কয়েক বছরে বিভিন্ন মাধ্যমে, নানা জনের চর্চায় বার্সেলোনার নাম যতটা না এসেছে মাঠের খেলার জন্য, তার চেয়ে বেশি হয়তো এসেছে মাঠের বাইরে তাদের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য। নতুন মৌসুমে বার্সা লিওনেল মেসিকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, ম্যানেজার বদলে জাভিকে আনতে হয়েছে এবং মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত ইউরোপা লীগে অবদমনীত হতে হয়েছে। 

সেইসঙ্গে কাটাছেঁড়া চলছে হুট করে আলোচনায় চলে আসা লা লীগার ‘ব্যয় সীমাবদ্ধতা’ নিয়মটি নিয়েও। স্প্যানিশ ফুটবলের প্রিমেরা এবং সেগুন্দা ডিভিশনে বিশেষভাবে ব্যবহৃত এই নিয়মটির ঠিকুজি খুঁজতে হলে যেতে হবে ২০১৩-তে, হাভিয়ের তেবাস যেবার লালীগার প্রেসিডেন্ট হয়ে এলেন। দায়িত্ব নিয়েই তেবাস স্পেনের সর্বোচ্চ স্তরের লীগ দুটির দলগুলোর জন্য একটি ‘আর্থিক নিয়ন্ত্রণ বিভাগ’ চালু করলেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষকদের নিয়োগ দেয়া হলো। যাদের কাজ প্রতিটি দলের আর্থিক খতিয়ান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করে করে প্রতি মৌসুমে দলগুলোর ব্যয়ের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া।

প্রতি গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোর পূর্বে ক্লাবগুলো তাদের সার্বিক আর্থিক বিবরণী লা লীগার নিকট হস্তান্তর করে। সেখান থেকে ক্লাবের আয়ের উৎস, শুরু হতে যাওয়া মৌসুমে সম্ভাব্য আয়, গত মৌসুমের লাভ-লোকসান, মাথাপিছু খরচ, বর্তমান সঞ্চয়, ঋণের বোঝা, বিনিয়োগ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ক্লাবগুলোকে ঐ মৌসুমে ব্যয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সেই নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ ক্লাবগুলো মূল দলের খেলোয়াড়, কোচ, সহকারী কোচ, ফিজিও, বি-দল, একাডেমির পেছনে খরচ করতে পারবে। বেঁধে দেয়া সীমানার মধ্য থেকে ট্রান্সফার এবং খেলোয়াড়-কর্মচারীদের বেতনের অর্থ ক্লাবগুলো নিজেদের সুবিধামতো বণ্টন করে নিতে পারে।

সন্দেহ নেই স্প্যানিশ মধ্যম এবং নিচু সারির দলগুলোর জন্য নিয়মটি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এক সময় দেনায় জর্জরিত ক্লাবগুলো নিজেদের আয় বুঝে ব্যয় করছে। তেবাসের ভাষ্যে, “রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার মতো দলগুলোকে একপাশে সরিয়ে স্প্যানিশ অন্যান্য ক্লাবগুলোর দিকে যদি আমরা নজর দেই, ‘ব্যয় সীমাবদ্ধতা’ আসার পূর্বে যেখানে তাদের সম্মিলিত দেনা ছিল ৩০০ মিলিয়ন ইউরো, সেখানে কোভিড প্রকোপের পূর্বে তাদের মোট আয় প্রায় ৩০০ মিলিয়নের কাছাকাছি”। লা লীগা কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধের ফলেই স্প্যানিশ ক্লাবগুলো অন্যান্য লীগের চাইতে ভালোভাবে কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছে। ২০১৯-এর গ্রীষ্মের ট্রান্সফার মার্কেটে লা লীগার দলগুলোর মোট ব্যয় যেখানে ১.২৪ বিলিয়ন পাউন্ড ছিল, ২০২০-এ সেটি ৩৬৭ মিলিয়নে নেমে এসেছে- ইউরোপের সেরা পাঁচ লীগের মধ্যে চতুর্থ।

মাঠের পারফর্ম্যান্স এবং মাঠের বাইরের বহুবিধ কার্যক্রমের কারণে প্রতি বছর দৈত্যাকার আয়ের মুখ দেখা রিয়াল কিংবা বার্সার জন্য উক্ত নিয়মটি মোটেও আমলে নেয়ার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু কোভিড-১৯ মাঠের দর্শক হতে প্রাপ্ত আয় পুরোপুরি এবং সম্প্রচার হতে প্রাপ্ত আয় অনেকাংশে কমিয়ে দেয়ায় বড় ক্লাবগুলোর ইনকাম প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ফলশ্রুতিতে, এতদিন যথেচ্ছ খরচ করে আসা বড় ক্লাবগুলোর এখন ‘ব্যয় সীমাবদ্ধতা’ যেন গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে। আয় কমে আসায় লা লীগা প্রতিটি ক্লাবের খরচের সীমা কমিয়ে দিয়েছে। বাজারের দিক থেকে বড় ক্লাবগুলোর এর ফলে ব্যয় করার সক্ষমতা কমে গেছে। কিন্তু পারফর্ম্যান্স ঠিক রাখতে এবং পূর্বেই স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী খেলোয়াড়দের বেতন পরিশোধ করতে ক্লাবগুলোর অর্থ খরচ না করে উপায় নেই। ২০১৯-২০ মৌসুমে বার্সেলোনার বেতন-সীমা ছিল ৬৭১ মিলিয়ন ইউরো, যা স্পেনে সর্বোচ্চ। কোভিড-জর্জরিত গত মৌসুমে সেটি নেমে এসেছে ৩৪৭ মিলিয়নে, আর এ বছর? ধারণা করা হচ্ছে ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর আশেপাশে কিছু একটা হবে যা সেভিয়ার বাজেটের কাছাকাছি। ৬৭১ মিলিয়ন ইউরো বাজেটের একটি দলকে দুই বছরের মাথায় ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর সীমানা নির্ধারণ করে দিলে তাদের পক্ষে মানিয়ে নিয়ে একপ্রকার অসম্ভব। এটি অনেকটা উৎসবের ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাই খেলোয়াড় বিক্রি এবং বর্তমান স্কোয়াডের বেতন কমানো বাবদ অন্তত ২০০ মিলিয়ন ইউরো ক্লাবের অ্যাকাউন্টে যোগ করা ছাড়া নতুন কাউকে নিবন্ধন করাবার্সার জন্য সম্ভবপর নয়। একের পর এক বাজে সাইনিং, খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত বেতন প্রদান, বিশাল ঋণের বোঝা, সেইসঙ্গে সবচেয়ে বড় আঘাত কোভিড- সবকিছু মিলিয়ে কাতালুনিয়ান ক্লাবটি অর্থনৈতিক বিচার্যে ইতিহাসের ভঙ্গুরতম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

নজর ফেরানো যাক স্প্যানিশ রাজধানীতে। কোভিড পরিস্থিতিতে রিয়াল মাদ্রিদের মূল দুটি আয়ের উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০১৯-২০ মৌসুমের ৬৪১ মিলিয়ন ইউরো বেতন-সীমা ২০২০-২১-এ ৪৭৩ মিলিয়নে এসে দাঁড়ায়, যা ঐ মৌসুমে স্পেনে সর্বোচ্চ। অনাগত মৌসুমের বেতন-সীমা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে এটি ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর ওপরই থাকবে। এই মৌসুমে বেতন-সীমা বার্সার (আনুমানিক ১৬৭ মিলিয়ন ইউরো) মতো এতটা না নামলেও বেশ বড় পরিবর্তনই আসতে চলেছে।

কোভিডে বাকি ফুটবল বিশ্বের মতোই রিয়াল মাদ্রিদও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; কিছু ক্ষেত্রে হয়তো অন্যদের তুলনায় অধিক। তবে সার্বিকভাবে মাদ্রিদ ম্যানেজমেন্ট পুরো বিষয়টিকে অন্য অনেকের তুলনায় সচেতন এবং পরিপক্ক উপায়ে সামলেছে। এটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় যখন বর্তমান ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় অধিকাংশ দলই ব্যক্তি মালিকানার অধীনে ‘যেমন খুশি তেমন খরচ’ খেলায় মেতেছে।

২০১৯-২০ মৌসুমে লস ব্ল্যাংকোসদের মোট বাজেট ছিল ৮২২ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু মৌসুমের মাঝপথে করোনার ধাক্কায় মাদ্রিদ পরিবর্তিত ৭১৫ মিলিয়ন ইউরোয় মৌসুম শেষ করে। ২০২০-২১ মৌসুমে বাজেট নামিয়ে আনা হয় আরও কম- ৬১৭ মিলিয়ন ইউরোয়। ১৯-২০ মৌসুমে মাদ্রিদ সমগ্র ইউরোপে সর্বসাকুল্যে দুটি দলের মধ্যে একটি যারা মুনাফার মুখ দেখেছে- ৩১৩,০০০ ইউরো (অপর দল বায়ার্ন মিউনিখ)। এ বছর মুনাফার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭৪,০০০ ইউরোয়- কোভিড জর্জরিত মৌসুমে এটিও ইউরোপে অনন্য।

সময় যত গড়িয়েছে, রিয়াল মাদ্রিদ বোর্ড ব্যয় যথাসম্ভব কমিয়ে আয়ের নতুন উৎস খোঁজায় মনযোগী হয়েছে। আশরাফ হাকিমি, সার্জিও রেগুইলন, অস্কার রদ্রিগেজের মতো প্রতিভাবান তরুণ তুর্কিদের বিক্রি করে কিংবা ব্রাহিম ডায়াজ, তাকেফুসা কুবো, মার্টিন ওডেগার্ডদের মতো খেলোয়াড়দের লোনে পাঠিয়ে মাদ্রিদ প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরোর ওপরে আয় করেছে। বড় ক্লাব মানেই বড় বেতনের বোঝা। অতিমারির প্রতিকূল সময়ে সেই বোঝা কমাতে দলের সর্বোচ্চ বেতন প্রাপ্ত খেলোয়াড়দের একজন গ্যারেথ বেলকে লোনে টটেনহ্যামে পাঠানো হয়েছে এবং আরেকজন হামেস রদ্রিগেজকে বিনামূল্যে এভারটনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।

আপাত স্থিতিশীল এই রিয়াল মাদ্রিদ প্রণয়নে খেলোয়াড়দের ভূমিকা কোন অংশেই কম নয়। ক্লাব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সম্পর্ক খানিকটা শীতল হওয়ায় ক্লাবের পরিচালক হোসে অ্যাঙ্গেল সানচেজ এবং অধিনায়ক সার্জিও রামোসের মধ্যস্থতায় সবমিলিয়ে প্রায় ১৫% বেতন কম নিতে রাজি হয় খেলোয়াড়েরা। সেইসঙ্গে ২০১৯-২০ মৌসুমের লীগ এবং স্প্যানিশ সুপারকোপা জেতা বোনাসও গ্রহণ করেননি তাঁরা। যার ফলে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরো সঞ্চয় হয় মাদ্রিদের।

লস ব্ল্যাংকোসদের ঋণের অঙ্ক কম নয়, প্রায় এক বিলিয়ন ইউরোর কাছাকাছি। কিন্তু এর সিংহভাগই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে পরিশোধযোগ্য। যেমন: সান্তিয়াগো বার্নাব্যু সংস্কারের জন্য গৃহীত ৫৭৫ মিলিয়ন ইউরো ৩০ বছর মেয়াদে শোধ করতে পারবে মাদ্রিদ। সেইসঙ্গে সম্প্রতি প্রকাশিত আর্থিক বিবরণীতে ক্লাবের নেট ঋণের পরিমাণ কমে আসার বিষয়টিও লক্ষ্য করা গেছে। ২০২০ সালে ক্লাবের নেট ঋণছিল ২৪০.৬ মিলিয়ন ইউরো যা এ বছর ৪৬.৪ মিলিয়ন ইউরোয় নেমে এসেছে।

ক্লাবের পরিচালক এবং সিনিয়র কার্যনির্বাহী কর্মকর্তারাও এই দুর্যোগের সময় নিজেদের বেতন কমিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদের বেতন এবং আয়ের অনুপাত ৫৭%, উয়েফার সুপারিশকৃত ৭০%-এর চেয়েও যা বহু কম। সেখানে বার্সার ক্ষেত্রে এই অনুপাত ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে লা লীগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাসও উচ্চকণ্ঠে রিয়াল মাদ্রিদের দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশংসা করে গেছেন।

এ পর্যন্ত এসে মনে হতে পারে রিয়াল মাদ্রিদ হয়তো কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে কিংবা সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে মাদ্রিদিস্তাদের জন্য। একথা সত্যি যে ইউরোপিয়ান অন্যান্য ক্লাবের তুলনায় কোভিড বিপর্যয় সামলানোয় মাদ্রিদ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, সেইসঙ্গে আপাত স্থিতিশীল একটি অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সদা পরিবর্তনশীল ইউরোপিয়ান ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের নিকট ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে কি?

রিয়াল মাদ্রিদের বাণিজ্য-সর্বস্ব প্রেসিডেন্টের কথায় বারবার উঠে এসেছে গত দু বছরে বাণিজ্যিক তথা আর্থিক খাতে মাদ্রিদের শোচনীয় অবস্থা। এই দুই বছরে মাদ্রিদ ৫০০ মিলিয়ন ইউরোর ওপরে খুইয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন আয়ের উৎস এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত আয়ের দিক থেকে সেরা দুটি ক্লাবের একটি মাদ্রিদ। কোভিডে সবকিছু একপ্রকার স্থবির হয়ে যাওয়ায় স্বভাবতই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি এসে লেগেছে স্প্যানিশ ক্লাবটিতে। যেমন: এ বছর প্রাক-মৌসুম সফর করতে না পারায় ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি হারাতে যাচ্ছে মাদ্রিদ।

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ‘ইউরোপিয়ান সুপার লীগ’। কোভিড-১৯ ক্লাবগুলোর আয়ের পথ বন্ধ করে দিলেও ইএসএলের আঘাতটি এসেছে অন্য দিক দিয়ে- ব্র্যান্ড ভ্যালুতে। ফুটবল এখন আর কেবল মাঠের খেলায় সীমাবদ্ধ নেই। ফুটবল এখন ততটাই মাঠের, যতটা মাঠের বাইরের। ক্লাবগুলো হয়ে উঠছে একেকটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড। ইএসএল কান্ডে রিয়াল মাদ্রিদের এই ব্র্যান্ড ভ্যালু গত বছরের চাইতে এ বছর প্রায় ১০% কমে গেছে। লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা চেলসির মতো ক্লাবগুলোর ব্র্যান্ড ভ্যালু চরম মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, এদের সঙ্গে মাদ্রিদের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। উল্লিখিত অন্য সকল ক্লাব যেখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন, মাদ্রিদ সেখানে সমর্থক মালিকানাধীন। আর একটি সমর্থক মালিকানাধীন ক্লাবের জন্য ব্র্যান্ড ভ্যালু কমে গিয়ে পৃষ্ঠপোষক হারানোর চাইতে বাজে কিছু হতে পারে না।

পৃষ্ঠপোষকতার প্রসঙ্গ যখন এলোই, রিয়াল মাদ্রিদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকদের দিকে আলোকপাত করা যাক। তার আগে বলে নেয়া ভালো, রিয়াল মাদ্রিদের আয়ের মূল উৎস কিন্তু খেলোয়াড় বিক্রি নয়, টিকিট বিক্রি নয় কিংবা সম্প্রচারস্বত্ব বিক্রিও নয়, বরং বিজ্ঞাপন এবং পৃষ্ঠপোষকদের থেকে পাওয়া অর্থই লস ব্ল্যাংকোসদের মূল চালিকাশক্তি। ২০১৯-২০ মৌসুমে এই খাত থেকে মাদ্রিদ ৩৭১ মিলিয়ন ইউরো নিজেদের পকেটে পুরেছে যা মোট ইনকামের ৪৫%। তবে সদা-সর্বদা নিরাপদ এবং আস্থাভাজন এই খাতের ব্যাপারে ইদানীং তেমনটি বলা যাচ্ছে না। ২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী, মাদ্রিদের সঙ্গে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে অ্যাডিডাস। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ২০১৯-এ স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুযায়ী ২০২৮ পর্যন্ত মাদ্রিদ বার্ষিক প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরো করে গ্রহণ করবে, বোনাস মিলিয়ে যা বছরে ১৫০ মিলিয়নও অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোভিড বিপর্যয়ে স্বয়ং অ্যাডিডাসের অবস্থাই টালমাটাল। বাধ্য হয়ে জার্মান সরকার হতে ২.৪ বিলিয়ন ইউরো ঋণ নিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। মাদ্রিদের আরেক প্রধান পৃষ্ঠপোষক এমিরেটস। আরব এই প্রতিষ্ঠান হতে বার্ষিক প্রায় ৭০ মিলিয়ন ইউরো আয় করে থাকে স্প্যানিশ ক্লাবটি। বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় বিমান সংস্থাটির পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের মতে, ২০২০ সালে প্রায় ২৮৯ বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ভক্সওয়াগন, স্যানিটাস, প্যালাডিয়ামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের সেরা অবস্থায় নেই । সবমিলিয়ে পৃষ্ঠপোষকদের দিক থেকে নির্ভরশীলতার জায়গাটা আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করেছে। ক্লাব তথা ফুটবল থেকে নিয়মিত অর্থের জোগান না এলে পৃষ্ঠপোষকেরা সহজেই মুখ ফিরিয়ে নেবে। এবং বাস্তবতা হচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকদের আকৃষ্ট কিংবা ধরে রাখবার জন্য নিজের সেরা রূপে রিয়াল মাদ্রিদ নেই। ২০১৯-২০ মৌসুমের ফুটবলবিহীন সময়টায় ক্লাবের গ্লোবাল ডিরেক্টর অব স্পন্সরশিপ, ডেভিড হপকিনসন আশংকা করে বলেছিলেন, “If there is no football soon, the sponsors may be looking for a refund of part of the money from their contracts or to make adjustments.” ফুটবল মাঠে ফিরেছে, ফেরেনি কোভিড-পূর্ব ফুটবলের রমরমাঅর্থনীতি।

রিয়াল মাদ্রিদের নামের সঙ্গে ক্ষুধার্ত, যে কোন মূল্যে জিততে চাওয়া মানসিকতার একটি সংযোগ রয়েছে। ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট এবং সমর্থকদের তাই ‘অধৈর্য’ হিসেবে কম দুর্নাম নেই। সদা সর্বগ্রাসী সেই মাদ্রিদ গত ১১ বছরে প্রথমবার একটি শিরোপাবিহীন মৌসুম কাটাল। সঞ্চয়ের নেশা পেয়ে বসা ক্লাবের গৃহীত নানা সিদ্ধান্ত সরাসরি এসে আঘাত করেছে মাঠের খেলায়। অতিমারির পূর্বে ২৫০ মিলিয়ন ইউরো খরচায় হ্যাজার্ড, জোভিচ, মেন্ডি এবং মিলিতাও চতুষ্টয়কে কেনা ২০১৯-এর গ্রীষ্মই ছিল মাদ্রিদের জন্য শেষ বড় ট্রান্সফার উইন্ডো। এই তালিকার প্রথম দুজন দামের দিক থেকে ওপরে অবস্থান করলেও, মাঠের খেলায় পুরোপুরি ব্যর্থ। পরবর্তী গ্রীষ্মে অপরীক্ষিত ব্রাজিলিয়ান কিশোর রেনিয়ার জেসুসকে ৩০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনার পর থেকে বড়-ছোট কেন, কোন ট্রান্সফার উইন্ডোই মাদ্রিদের দরজায় কড়া নাড়েনি। সেইসঙ্গে চলেছে পরীক্ষিত এবং একের পর এক তরুণ খেলোয়াড় বিক্রি। অর্থনৈতিক নিরীখে আপাত সাফল্য লাভ করলেও, এই সবকিছুর খেসারত মাদ্রিদ দিয়েছে ৬০টি ইঞ্জুরি সংবলিত শিরোপাবিহীন মৌসুম কাটিয়ে। সৌভাগ্যজনকভাবে ক্লাবের ডাগআউটে জিনেদিন জিদান থাকায় পুরো মৌসুমটিকে একটি ভদ্রস্থ রূপ দেয়া গেছে।

২০১৩-১৫-এর সময়টার একদম বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে স্প্যানিশ রাজধানীতে আসছেন কার্লো আনচেলত্তি। ধারে হোক কিংবা ভারে, বর্তমান মাদ্রিদ সেই সময়কার ছায়া বৈ অন্য কিছু নয়। আনচেলত্তির প্রথম মেয়াদের সাফল্যের বহু কারিগর অন্য ক্লাবে থিতু হয়েছেন, যাঁরা রয়েছেন, অধিকাংশই নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন- তা সে ২৯ বছর বয়সী ইস্কোই হোন বা চুক্তির শেষ বছরে ক্লাবের অধিনায়কত্ব পাওয়া মার্সেলো। এক বছরের লোন পর্ব কাটিয়ে দলে ফিরছেন গ্যারেথ বেল। আনচেলত্তির অধীনে উড়তে থাকা যে বেল শেষ কয়েক বছরে মাদ্রিদে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছেন। অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাওয়া স্প্যানিশ ক্লাবটির মোট বেতনের ১৩%-ই ব্যয় হয় বেল এবং নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারা আরেক উইংগার এডেন হ্যাজার্ডের পেছনে। স্বভাবতই, সম্ভাব্য সব দিক থেকে ব্যয় কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা মাদ্রিদ ম্যানেজমেন্টের প্রধান উদ্দেশ্য বেল এবং হ্যাজার্ডের বেতনের বোঝা ঘাড় থেকে নামানো; বিশেষত যখন পারফর্ম্যান্সের বিচারে মুনাফা শূণ্য। বাজে ফর্ম এবং ক্রমাগত ইঞ্জুরিতে জর্জরিত হ্যাজার্ডের দায়িত্ব অন্য কোন ক্লাব এই মুহূর্তে নিতে রাজি নয়। বিশাল অঙ্কের বেতনের কারণে একই কথা বেলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিভিন্ন রিপোর্ট মোতাবেক, এ মৌসুম স্পেনেই কাটাবেন ওয়েলশ অধিনায়ক। ২০২১-২২ মৌসুম শেষে বেল বিদায় নিলেও হ্যাজার্ড ২০২৪ পর্যন্ত দলের সঙ্গে রয়েছেন। ফিটনেস কোচ অ্যান্টোনিও পিন্টাসের সঙ্গে বসে এ দুজন খেলোয়াড়ের থেকে সেরাটা বের করার গুরুদায়িত্ব তাই আনচেলত্তির কাঁধে। নতুবা, ক্লাবের অর্থনৈতিক এই দুঃসময়ে উলু বনে মুক্তো ছড়ানোই সার।

বেতন, বর্তমান ট্রান্সফার মার্কেট, খেলোয়াড়ের সম্ভাবনা ইত্যাদি বিবেচনা করেমাদ্রিদ পরিচালনা পর্ষদ এবং কার্লো আনচেলত্তি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে মৌসুম শুরুর পূর্বেই। দলের গোলস্কোরিং সমস্যা দূরীকরণে মারিয়ানো ডায়াজ এবং লুকা জোভিচকে ট্যাক্টিকাল কৌশলে খাপ খাইয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় এ মুহূর্তে নেই। ক্লাব জোভিচকে বিক্রির জন্য তৈরি থাকলেও তাঁর বিশাল অঙ্কের বেতন এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।  মাঝেসাঝে এক-দুটো গোল অ্যাসিস্ট ছাড়া জোভিচ বেঞ্জেমার যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারেন নি, পারবেন কিনা, কে জানে?  মার্কো আসেন্সিও, রদ্রিগোর মতো খেলোয়াড়েরা এখনও ক্লাবের আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। ব্রাহিম ডায়াজকে দুই বছরের লোনে এসি মিলানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, রিয়াল সোসিয়েদাদে লোনে যাবার জোর গুঞ্জন রয়েছে তাকেফুসা কুবোরও, লুকাস ভাস্কেজের চুক্তি নবায়নের অর্থ সম্ভাব্য ক্রেতা পেলে আলভারো অদ্রিওজোলাকে বিক্রি করে দেয়া হবে, লেফটব্যাক পজিশনে খেলোয়াড়ের আধিক্য মিগুয়েল গুতিরেজকে হয়তো লোনে যেতে বাধ্য করবে। বেতন স্কেলে সার্জিও রামোসের অবস্থান এবং জার্সির পেছনে তাঁর নাম্বার অধিকার করা ডেভিড আলাবাকে আনচেলত্তি কোন পজিশনে খেলান, সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আনচেলত্তির আগের মেয়াদে অভিষেক হয়েছিল ওডেগার্ডের। কোচের নতুন মেয়াদে তরুণ এই মিডফিল্ডারের বিষয়ে ক্লাবের সিদ্ধান্ত সকল পক্ষের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ হতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ওডেগার্ডের আর্সেনালগমন তাঁর ভক্তদের হতাশ করলেও রিয়ালের জন্য গুরুত্তপুর্ণ অর্থের যোগান এসেছে।অলিম্পিক থেকে ফিরে ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে আরেক মিডফিল্ডার দানি সেবায়োসের।ইঞ্জুরড দানি সেবায়োস কবে ফিরবেন, আদৌও কি ফিরবেন, তাও কারো জানা নেই।পূর্ববর্তী কয়েক বছরের কার্যক্রম থেকে এটি পরিষ্কার যে সঠিক প্রস্তাব আসলে ক্লাব সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের বিক্রি করতে দ্বিধা বোধ করবে না। মন্দার এই সময়টায় ভীষণ যাচাই-বাছাই করে, অর্থ এবং পারফর্ম্যান্স উভয় বিষয় মাথায় রেখে স্কোয়াড নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ক্লাব। কোচ আনচেলত্তির কথায় তাই বারবার স্কোয়াড মূল্যায়নের বিষয়টি উঠে এসেছে- “We have a very big squad, and the first thing we have to do is evaluate the players we have, and reduce it a bit. We’ll have to see how we do that. I know the squad very well, the young players too, and those coming back from loans. We have many options in the squad, (and) need to calmly evaluate everything.”

স্প্যানিশ বিভিন্ন গণমাধ্যম এ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদে বড় একটি সাইনিং-এর সম্ভাবনা দেখলেও ক্লাবের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা তেমনটি বলছে না। একটি বড় সাইনিং অনেক যদি/কিন্তুর ওপর নির্ভরশীল। তেমন কেউ ক্লাবে এলে অন্য অনেকের চলে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে সবমিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ‘প্রজেক্টের’ কী হাল হয় সেটিও দেখবার। এক পর্যায়ে এম্বাপ্পে আসছেন, শুনলেও গুঞ্জনই রয়ে গিয়েছে খবরটি। 

শেষ করি আবার জিদানের কথায়- “…nor the support to build something in the medium or long term”. প্রকৃতপক্ষে এটিই লস মেরেঙ্গাসদের পরিস্থিতি। ক্লাবের আর্থিক অবস্থাকে আপাতত কোনমতে সামাল দেয়া গেলেও, বড় কোন কিছুর প্রত্যাশা করাটা হয়তো খানিকটা বাড়াবাড়ি। যে ‘প্রজেক্টের’ লোভে খেলোয়াড়েরা নতুন ক্লাবে পাড়ি জমান, বর্তমান মাদ্রিদে তেমন একটি প্রজেক্টের বড়ই অভাব। আনচেলত্তির স্কোয়াডের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার কথা। ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লাবগুলোর রমরমা, পরিচালনা পর্ষদের নানা ভুল সিদ্ধান্ত, কোভিড বিপর্যয় এবং ক্লাব প্রেসিডেন্টের একমুখী নীতি- সবমিলিয়ে ইউরোপের সফলতম ক্লাবটির সামনে হয়তো ইতিহাসের কঠিনতম সময় অপেক্ষা করছে।

অ্যাথলেটিকের ছায়ানুবাদ। 

You May Also Like