করিম বেঞ্জেমাঃ ভাঙা আঙ্গুলের সাদা পতাকার কর্ণ

বক্সের মাঝে বল ঘুরছে পা হতে পায়ে। হঠাৎ বল বেড়িয়ে গেলো জটলার ভেতর হতে। কেউ দিয়েছে নাকি ছিটকে গেছে বোঝা দায়। পর মুহূর্তেই বেঞ্জেমার পায়ে বল। সামনে নিজেকে বড় আকৃতি করার এক প্রাচীন চেষ্টারত গোল কিপার। সেটার আর খুব বেশি দরকার হতো না। বেনজেমার পায়ে লেগে বল উড়ে চলে যাচ্ছে বক্সের উপর দিয়ে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সাদা দেয়াল থেকে ভেসে আসছে ব্যু ধ্বনি। মরিনহো পাথুরে মুখে দাড়িয়ে অথবা কার্লো আঞ্চেলোত্তি তার বর্ষীয়ান চেহারায় আরো কিছু ভাঁজ ফেলে হেঁটে যাচ্ছেন ডাগ আউটের দিকে অথবা জিদান যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রামোসকে তাগাদা দিচ্ছেন পেছনে ফিরে আসার।

আর বেঞ্জেমা?

মিস করার পর শিশুতোষ হাসি, বিরক্তি ও হতাশার মিশ্রণে কী মুখভংগি করলেন তা তিনিই জানেন। তবে সেটা নিঃসন্দেহে মাদ্রিদিস্তাদের বেশ খুশি করতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। যার প্রমাণ বার্নাব্যুতে ব্যু অথবা সোশাল মিডিয়ায় বেঞ্জেমা আউট হ্যাশট্যাগে ভরে যাওয়া। এইতো ছিলো বেঞ্জেমার রিয়াল জীবন। তাইনা? দাঁড়ান! 

নামে বিবিসি হলেও বেল, রোনালদোর মতো রাজপুত্রের মাঝে বেঞ্জেমা কেবলই এক সূতপুত্র। গোলাজোওও দে গারেথ… বেইললললল অথবা গোলাজো দে ক্রিত্তিয়ানো… রোনালদোওওও নামে যত উল্লাসধ্বনিতে জেগেছে বার্নাব্যু তার সিকিভাগ ও বেঞ্জেমার ভাগ্যে আসেনি। কথা এসেছে জিদানের নেপোটিজমের। অথচ, এই ফরাসি নাম্বার নাইনকে না পর্তুগীজ মরিনহো, না ইতালিয়ান কার্লো আঞ্চেলোত্তি না স্প্যানিশ বেনিতেজ, না আর্জেন্টাইন সোলারি বেঞ্চ করেছেন। সবাই দলের একাদশে রেখেছেন সিংহভাগ ম্যাচেই। 

যার নামে সবচেয়ে বেশি নেপোটিজমের ফিসফিসানি, সেই জিদানের সময়েই দেখানো শুরু করলেন নিজের ম্যাজিক। এতলেতিকোর ঘরের মাঠে গোডিনের মতো পোড়খাওয়া ব্যাককে ঘোল খাইয়ে গোললাইন ধরে টেনে আনা বলের যে ম্যাজিক… এতো গোটা দশেক গোল থেকেও সুন্দর। বার্সেলোনার বিপক্ষে ব্যাক ফ্লিকে স্টেগানকে পরাজিত করে জালে জড়িয়ে দেয়া সেই আলতো পরশ কী পিকাসোর ব্রাশের ব্যাক স্ট্রোকের চেয়েও কম?

আঙ্গুল ভেংগেছেন। তাও দলের কন্টকাকীর্ণ সময়ে অপারেশন করেননি দলকে সঞ্জীবনী অক্সিজেন যোগাতে। ভালবুয়েনা কান্ডে লম্বা সময় ধরে জড়িয়ে জায়গা হারালেন ফ্রান্স দলের নামখাতা হতে। ফেডারেশনের মহারথীরা বললেন আলজেরিয়া চলে যেতে। ওদিকে মোরাতাকে কেন রাখা হলোনা, জোভিচকে কেন টাইম দেয়া হয় না এত প্রশ্নবাণে নিশ্চল কোচ খেলিয়ে যেতে লাগলেন বেঞ্জেমাকে। আর রোনালদো বিহীন, গলফে মজা বেলবিহীন এক ভাঙা টিমকে নিয়ে জিতলেন লীগ, পরেরবার সামান্যর জন্য হলোনা ‘ব্যাক টু ব্যাক’। ‘বেঞ্জেমা আউট’ লিখে কিবোর্ড কাপানো ছেলেটি ‘বেঞ্জেমা ইজ গোট’ হ্যাশট্যাগে পোস্ট দেয়। যাকে ফ্রান্স টিম ছেড়ে আলজেরিয়া চলে যেতে বলা হয়েছিলো সেই তাঁকেই ফেডারেশন ও কোচ মিলে ফেরত আনলেন ন্যাশনাল টিমে, ফাইনালে গোল করে জেতালেন ন্যাশন্স কাপ। যেই বেঞ্জেমাকে নিয়ে বিরক্ত ছিলো মানুষ, সেই বেঞ্জেমার স্তুতি উঠলো, ব্যালন ডি অর এর লিস্টে নাম উঠলো হু হু করে উপরের দিকে।

সবই পাল্টিয়েছে। একটা সময় বেঞ্জেমাকে সাপোর্ট দিয়ে গালি খেয়ে যাওয়া মানুষগুলো এখন বেঞ্জেমার সাফল্যে তালি মারার লাইনে ব্যাকবেঞ্চে। ব্যালনের লিস্টে নাম উঠেছে। এখন আর কেউ বলেনা ফরাসি নেপোটিজমের কারণে বেঞ্জেমা খেলে।

শুধু পাল্টায়নি তিন জিনিস। বেঞ্জেমার ভাঙা আঙ্গুল, তার বিনয় ও ডেডিকেশন।

মহাভারতে সূতপুত্র কর্ণকে মালা পড়ায় নি দ্রৌপদী। কারণ সে সূতপুত্র। ভাগ্যের পরিহাসে অর্জুনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাঁকে। যখন স্বয়ং কৃষ্ণ সমাসীন অর্জুনের সাথে সারথি হিসেবে তখন কে হারাবে অর্জুনকে। অথচ, নিজের গোলামির কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কর্ণ রয়ে গেলো বিপক্ষ শিবিরেই। যুদ্ধের ময়দানে অন্তিম মুহূর্তে রথ দেবে গেলো মাটির মধ্যে। বেঞ্জেমা আমাদের সে সূতপুত্র। নেপোটিজম, হঠাৎ রিস্টার্ট নেয়া মামলা ও সাসপেন্ডেড জেল, টক্সিক ফ্যানবেজ ও জার্নালিস্ট এবং ভোটের মতো এক সার্কাস সিস্টেমে মাটিতে দেবে গেলো ব্যালন; একেবারে যেন অন্তিম মুহূর্তে। মালা পড়ালো না আপনারই ঘরের পত্রিকা।

ফরাসি ভাষায় ব্যালন ডি অর মানে স্বর্ণালী বল।

বেঞ্জেমা!

আপনার প্রতিটা টাচই তো টুশে ডি অর।

আপনিই আমাদের গোল্ডেন প্লেয়ার, জোয়ে ডি অর। আর কটা বছর এই ম্যাজিক দেখিয়ে যান। হাজারো মাদ্রিদ প্লেয়ারের ভীড়ে এই ভাঙা আঙ্গুলের মাদ্রিদিস্তা নুয়েভেকে মিস করবে বার্নাব্যু। সেদিন হয়তো উঠবে ‘Merci Karim’। ততদিন আপনিই আমাদের জোয়ে ডি অর, সোনালি খেলোয়াড়; আমাদের KB9.

‘বেঞ্জেমা আউট’ হতে ‘বেঞ্জেমা ব্যালন ডিঅর’ হ্যাশট্যাগে ভরে উঠাটাই আপনার জন্য বড় প্রাপ্তি। রিয়েল স্টিল ছবির ম্যাক্স ক্যান্টনের সেই বিখ্যাত শেষ সংলাপের মতো ‘Peoples’ Champion? Sounds pretty nice to me!’

বিগ বেঞ্জ, আপনিই আমাদের চ্যাম্পিয়ন। সাদা ঝান্ডা উড়িয়ে চলা ভাঙা আঙ্গুলের এক প্রাচীন সৈনিক। 

 

Cover image from the internet. 

You May Also Like