মরিয়া গিয়াছে জোগা বনিতো! (প্রথম পর্ব)

স্বভাবগতভাবেই গতিহীন কিন্তু এক ধরনের আভিজাত্য মেশানো কমনীয়তা থাকে তাদের নড়াচড়ায়। সেটা ধরে রেখেই মাঠের বাম দিক ঘেষে গুটি গুটি পায়ে আক্রমণে ওঠার কথা ভাবছিল ইতালিয়ানরা। কিন্তু হাফলাইন পার হতেই তুমুল বাধা। বল হারাল নীল জার্সিধারীরা। গুনে গুনে মাত্রই কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বল গিয়ে জমা পড়ল সুযোগের সন্ধানে থাকা জোয়ার্জিনহোর পায়ে। ইতালিয়ান ডিফেন্সে ততক্ষণে বিপদঘন্টা বেজে উঠেছে কারণ পেলে পৌছে গেছেন তাদের বক্সে আর তার দিকেই গড়িয়ে চলেছে বল। ইটালিয়ান ডিফেন্স, দর্শক ধারাভাষ্যকার সবার নজর পেলের পায়ে। এর পরেই এল সেই জাদুকরি মূহুর্ত। বক্সের একদম মাঝ বরাবর দাঁড়ানো পেলে শট, পাস, লব কিংবা থ্রু কোন প্রচলিত সমাধানে না গিয়ে পেলে প্রায় না দেখেই অলসভাবে একরকম পা লাগিয়ে বলটাকে গড়িয়ে যেতে দিলেন বক্সের ডানপ্রান্তে। ডান প্রান্ত থেকে প্রায় উল্কার মত দৌড়ে এসে বলটাকে জালে ঠেলে দিলেন যে কার্লোস আলবার্তো টরেস!

১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে কার্লোস আলেবার্তো টরেসের সেই বিখ্যাত গোল! (ভিডিওঃ Soccerex)

এই গল্প ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের। আর দলটি তর্কযোগ্যভাবে ইতিহাসের সেরা আন্তর্জাতিক দল। কিন্তু জুলে রিমে নিজেদের দখলে নিয়ে যাওয়া কিংবা পেলের শেষ বিশ্বকাপ বলে নয়- ব্রাজিল বললেই যে ঘরাণার ফুটবল মানুষ প্রত্যাশা করে তার মানদন্ড সম্ভবত এই দলটিই। এই ফুটবলের ট্যাকটিকাল আলোচনা হয় অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে। পেলের মত ১০ আর ৯ এর মিশেল কোন ফরোয়ার্ড কীভাবে কাজ করেন সেটা যেমন ইউরোপের ফুটবল আগে কোনদিন দেখে নি, তেমনি কার্লোস আলেবার্তোর মত রাইটব্যাক উঠে এসে কেন গোল করছেন এই প্রশ্নের উত্তর ও তখন ইউরোপিয়ানদের একদমই জানা ছিল না। কিন্তু যেটা ইউরোপিয়ানদের একদমই মাথায় ঢোকেনি সেটা হচ্ছে এরা ফুটবলটা এভাবে খেলে কেন?

ইউরোপিয়ান ফুটবল জন্মলগ্ন থেকেই একটি দলগত খেলা। এখানে বল ধরে রাখা অন্যায়। এক টাচে বল ছাড়তে পারা কিংবা দলের জন্য নায়ক না হয়ে ভিলেন হতে পারাটাই এখানে খেলার কিংবদন্তী তৈরি করে দিতে পারে। আর বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে তো শিশুকাল থেকে ফুটবল খেলতে চাইলে নিয়ম কিংবা ফর্মেশানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতেই হবে আপনাকে। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকায় ফুটবল মানে পায়ে বলের স্পর্শ, ফুটবল মানে হারতে না চাওয়ার প্রায় অবুঝ পর্যায়ের আবেগ। ল্যাটিন ফুটবল অভাবের ঘরে আলো আসার জানালা। ল্যাটিন ফুটবল আপনার আমার না পড়েই ভালবাসা কবিতা। এই কারণেই আর্জেন্টাইন ম্যারাডোনা বাঙ্গালির “নিজেদের লোক” হয়ে গিয়ে দুই তিন প্রজন্মকে বানিয়ে দিয়েছেন আকাশী নীলের সৈন্যদল আর এই কারণেই লুইস সুয়ারেজ লাল কার্ড খেতে হবে জেনেও হাত দিয়ে ঠেকাতে যান পেনাল্টি।

কিন্তু ব্রাজিল? আর দশটা ল্যাটিন আমেরিকান দেশের মত ব্রাজিলেও ফুটবল আবেগ, প্রত্যাশা কিংবা বিদ্রোহ ও। কিন্তু ব্রাজিলে ফুটবল এর সাথে সাথে অপার আনন্দ ও। আপনি কলম্বিয়ানদের বলতে পারেন ভাবালু, উরুগুইয়ানদের বলতে পারেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিংবা আর্জেন্টাইনদের বলতে পারেন আবেগী। সেই হিসাব করলে ব্রাজিলিয়ানরা হচ্ছে ফুর্তিবাজ। তাদের জন্য বেঁচে থাকার রসদ হচ্ছে আনন্দ। আর ফুটবল সেই আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া প্রতি দিনের সলতে। রিওর সমুদ্র সৈকতে ভলিবলের নেট টানিয়ে খেলা যে ফুটবল দিয়ে সেই ফুর্তির শুরু, পাচ তারকার বিখ্যাত হলুদ জার্সিতেও ব্রাজিলিয়ানরা চায় সেই একই আনন্দ। খেলায় জেতার চেয়ে তাদের কাছে দরকারী মন ভরানো, হাসি ফোটানো। এই আদর্শের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার শুরুটা অবশ্য ১৯৭০ এর অনেক আগে। বিশ্বকাপের জন্মের প্রথম ২০ বছরে ব্রাজিল শুধু আনন্দই বিলিয়ে গেছে। ট্রফির দেখা তাদের মেলেনি। 

“টোটাল ফুটবল” কিংবা “টিকি টাকার” মত “জোগো বনিতো” ও একটি ফুটবল আদর্শ। এর মূল কথা “আনন্দের জন্য খেলা”। খেলা দেখে দর্শক যেমন আনন্দ পাবেন, খেলে আনন্দ পেতে হবে খেলোয়াড়কেও। এখানে বল ধরে রাখায় কোন বাধা নেই। বাধা নেই টুইস্ট, টার্ন কিংবা সামর্থ্যে কুলালে রেইনবো ফ্লিক করে বসতেও। ফাভেলার চাপা আর উচুনিচু পথে ভারসাম্যহীন বল নিয়ে খেলতে খেলতে যে অস্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ আর প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবার প্রায় অতিপ্রাকৃত সামর্থ্য তার ব্যবহারিক প্রয়োগ মাঠে নিয়ে আসাই ছিল এই আদর্শের প্রথম ও শেষ কথা। তবে এই আদর্শের কোন ধরাবাধা আকার বা ফর্মেশান ছিলনা কোনকালেই। বরং “জোগো বনিতো” কে বলা যেতে পারে একটি মানসিক অবস্থা। 

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের কল্যাণে “জোগো বনিতো” নামের পর্তুগীজ শব্দযুগল শোনেননি এমন খেলাপ্রেমী খুজে পাওয়া যাবে না একজন ও। কেন ব্রাজিল সমর্থন করেন এর উত্তরে “পাসিং ফুটবল” কিংবা “সুন্দর ফুটবল” বলে প্রায় জ্ঞান হারানো সমর্থক খুজতে গেলে দেশের অর্ধেক লোক গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন সেই লাইনে দাঁড়াতে। কিন্তু বিড়ম্বনার বিষয় হচ্ছে আজকের প্রজন্মের ফুটবল দেখা শুরু যে সময়টায় ঠিক সে সময়টাতেই মরতে শুরু করেছিল “জোগো বনিতো”। আজ ২০২০ এর কোটা পার করে একদম দাঁড়ি দিয়ে বলে ফেলা যায় “আর বেঁচেই নেই সেই সুন্দর ফুটবল।”

আমার দেখা প্রথম বিশ্বকাপ ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপ। স্কটল্যান্ডের সাথে কষ্টে সৃষ্টে ২-১ গোলে জিতে বিশ্বকাপ শুরু করা ব্রাজিলকে নিয়ে আমাদের ড্রয়িং উঠেছিল এক চিরায়ত বাণী- “ব্রাজিল আর আগের মত খেলে না”। এই পর্যায়ে বাংলার আপামর জনসাধারণ আমার লেখার উপর ধৈর্য্য হারাবেন। কী বলছি আমি এসব? ২০০২ সালে জোগা বনিতোর মোহাচ্ছন্ন করে কী ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতেনি? কিংবা রোনালদো, রিভালদো, কার্লোস, কাফু বা রোনালদিনহোরা কি মনের আনন্দে ফুটবল খেলতেন না? আর যদি মরে গিয়েই থাকে কি ঘটেছে ব্রাজিলের সেই “সুন্দর ফুটবল” এর ভাগ্যে?

এক কথায় ব্রাজিলের ফুটবলকে যা মেরে ফেলেছে তার নাম “বিশ্বায়ন”। ব্রাজিলের সুন্দর ফুটবলের আলোচনা শুরুর আগেই বলেছিলাম এটি ছিল সেই ফুটবল আদর্শ যা ইউরোপিয়ানরা কোনদিন দেখেনি বা শোনেও নি। ১৯৭০ এর বিশ্বকাপ জয়ী দলের নায়ক পেলে বা জোয়ার্জিনহোরা সারাটা ক্যারিয়ার ই কাটিয়েছেন ব্রাজিলের ঘরোয়া লীগে। ১৯৭০ পর্যন্ত ব্রাজিল বা কোন ল্যাটিন আমেরিকান দল যতবারই বিশ্বকাপে আসত তাদের বোতলে লুকানো থাকত কিছু নতুন চমক। ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক, ৪-২-৪ ফর্মেশানে আক্রমণভাগে পুরো ৯০ মিনিট জুড়ে ওভারলোডিং করা, নিজেদের অর্ধ থেকে প্রেস করতে শুরু করা কিংবা বল পায়ে ৩০-৪০ গজ ড্রিবল করা কিংবা প্রতিপক্ষকে ২-৩ গজ জায়গার ভেতর রীতিমত হেনস্তা করে একা কিংবা দলগত ভাবে শুধুই সামনে এগিয়ে যাবার মত বিষয়গুলো নামজাদা ইউরোপিয়ান দলগুলিকেও একসময় ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিত। 

Brazil's 1982 World Cup goalkeeper Waldir Peres dies after heart attack

জিকো, সক্রেটিস আর ফ্যালকাওদের নিয়ে গড়া ৮০ এর দশকের ব্রাজিল দল “জোগা বনিতো’র” আনন্দে মন ভরে দিলেও ছুয়ে দেখা হয়নি বিশ্বকাপ শিরোপা (ছবি ESPN)

আর ব্রাজিলিয়ানদের আতুরঘরে ছিল অবিশ্বাস্য সব প্রতিভা। পেলের মত দুই পায়ের সব্যসাচী ফরোয়ার্ড কিংবা গ্যারিঞ্চার মত এক পা ছোট ড্রিবলাররা জন্মাতেন এবং বেড়ে উঠতেন একদমই নিজেদের মত করে। উপভোগ করতেন স্বাধীনতা এবং নিজেদের আত্মপরিচয়ের গর্বেই খেলে যেতেন গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে। কিন্তু বিশ্বায়নের জোয়ারে এখন সাধারণ ইউরোপিয়ান ফুটবলারদের মতই ব্রাজিলিয়ানরাও কৈশোরেই ঢুকে যান কোন ইউরোপিয়ান ক্লাবের একাডেমিতে। সেখানে ফর্মেশান, ট্যাকটিক্স কিংবা দ্রুত বল ছাড়ার শিক্ষাটাও পান একদম ইউরোপিয়ান ঘরাণাতেই। ইউরোপিয়ান ফুটবলে লম্বা সময় টিকে থাকতে গেলে কিংবা সেখানে সাফল্য পেতে হলে এটা একরকম দৈনিক পথ্য। কিন্তু ইউরোপিয়ান খেলায় আপনি যদি ইউরোপিয়ানদের চেয়ে ভাল করতে চেষ্টা করেন তাহলে সেটা কঠিন হবে সেটাই স্বাভাবিক।

৭০ এর দশকে প্রথমে ডাচ ও পরে জার্মান ফুটবলের সুতিকাগারে যে নতুন যুগের সূচনা হয় তা থেকেই জোগো বনিতোর মৃত্যুর শুরু। ইউরোপিয়ানরা প্রথমে ল্যাটিন ফুটবলের আক্রমণাত্বক চরিত্রগুলির মাঝে কিছু কিছু বাছাই করে নিজেদের খেলায় ঢুকিয়ে নিতে থাকে। প্রথমেই চলে আসে আক্রমণ আর রক্ষণে ফুলব্যাকদের অংশগ্রহণ। ৪-২-৪ কে ভেঙ্গে ডাচরা তৈরি করে ৪-৩-৩। ইতালী বা স্পেনে আক্রমণাত্নক মিডফিল্ডাররা গোল করতে আরো মনোযোগী হন। ফ্রান্স, স্পেন, ইটালি, পর্তুগাল থেকে একটি প্রজন্ম উঠে আসে যারা ২০ গজ না হলেও ১০-১২ গজ ড্রিবল করতে কোচের চোখ রাঙ্গানিকেও ভয় পান না।

এখান থেকেই ব্রাজিলের ফুটবলের “বিশেষত্ব” হারানোর শুরু। কারণ ব্রাজিল এই সময়কালে জিকো, রিভেলিনো কিংবা সক্রেটিসের মত প্রতিভার জন্ম দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আনন্দের জন্য খেলতে তারা যা যা করত ঠিক তাই তাই ইউরোপিয়ানরাও করতে শুরু করেছিল। সাথে যোগ হয়েছিল ফল পাবার ইউরোপিয়ান নিয়মটিও। আর ফল নিজেদের পক্ষে ধরে রাখতে আক্রমণের পাশাপাশি ভরাট রক্ষণ, যে কোন মূল্যে আক্রমণভাগে প্রতিপক্ষের নড়াচড়া আটকে দেয়া আর চুলচেরা বিশ্লেষন। অংকের হিসাবে ইউরোপিয়ানরা ফুর্তিবাজ ব্রাজিলিয়ানদের আটকে দিতে শুরু করেছিল বারে বারে। এই কারণে ৭০ আর ৮০ এর দশক ছিল হলুদ জার্সিদের হৃদয় ভাঙ্গার দশক। প্রতিবার তারা একটি প্রতিভায় ভরপুর দল নিয়ে আসত। যে ম্যাচে ভাল খেলত সেই ম্যাচে সমর্থকদের হৃদয় ভরে যেত। কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষে দেখা যেত মন ভরে দিলেও জোগো বনিতোর দোহাই এ খালিই রয়ে যাচ্ছে ট্রফির ক্যাবিনেট। এর পরে জোগো বনিতো কি আর বেঁচে থাকতে পারত?

১৯৯৪ সালে রোমারিও বেবেতোর নৈপুণ্যে ব্রাজিল আবার বিশ্বকাপ জিতে ফিরেছিল আবারো। তারপর তারা টানা আরো দুইটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে। কিন্তু নিখাদ সত্যটা হচ্ছে জোগো বনিতো আর বেঁচে ফেরেনি কখনোই। আগামী পর্বে পড়ুন কীভাবে ব্রাজিলের সোনালী প্রজন্মের পায়ে মরে গিয়েও মরীচিকার মত টিকে ছিল “সুন্দর ফুটবলের” মোহমায়া।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

You May Also Like