অ্যাথলেটিক বিলবাও, শিল্প-বিপ্লব এবং স্প্যানিশ পেইন্টিং

কাউকে যদি মোটাদাগে স্পেনের পাঁচটি সেরা ক্লাবকে নিয়ে কথা বলতে বলি সেই লিস্টে অ্যাথলেটিক বিলবাও অবশ্যই থাকবে। এই অ্যাথলেটিক ক্লাব দিকে নিয়ে আমার একটু দুর্বলতা আছে ব্যক্তিগতভাবে, কারণ আমার খুব কাছের একজন বন্ধু বিলবাও শহরে থাকেন। তার কাছ থেকেই শোনা, শহরটি খুবই সুন্দর, পাহাড়ি, উঁচু-নিচু মনোরম রাস্তা আর এজন্য আমার বন্ধুর হাঁটতে কষ্ট হয় কারণ তিনি আগে একজন ধূমপায়ী ছিলেন। (সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর)।

তবে আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার লাগে ক্লাবটির নাম । সাধারণত বেশিরভাগ ক্লাবে আমরা স্প্যানিশ ভাষায় নাম দেখলেও অ্যাথলেটিক শব্দটি ইংরেজি। এই ক্লাবেরই স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে যে এই শাখাটি, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ,সেটিও স্প্যানিশে তাদেরকে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আসলে ব্যাপারটা এখানেও ইংরেজদের সাথে জড়িত। তাঁরাই অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের জন্ম দিয়েছিলেন ইংরেজি নামে। শুধু নামের দিক থেকে নয় স্পেনের অন্যান্য ক্লাবের সাথে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বেশ ভালো দূরত্ব আছে। সংস্কৃতিগত,  আঞ্চলিক রাজনীতি গত, এবং ফুটবলীয় দর্শনগত মোটামুটি সবদিক দিয়েই তাঁরা আলাদা। এর মধ্যে আঞ্চলিক ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। মাদ্রিদ বেতারের কিছু দর্শক হয়তো জানেন কেবলমাত্র অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের তাদের সমস্ত খেলোয়াড়দের শুধুমাত্র বাস্ক অঞ্চল থেকে নিয়ে থাকেন। কেন নিয়ে থাকেন কেনই বা ক্লাবটি এরকম এ সমস্ত বিষয় নিয়ে আজকে আমরা কথা বলব আমাদের এই পর্বে। 

এবার একটু চলে আসা যাক আজ থেকে ১০০ বছর আগে। ১৯২৮-২৯ সালে যখন স্প্যানিশ লিগ টি শুরু হয়েছিল তখন কাতালুনিয়া থেকে এস্পানিওল এবং ক্লাব দেপোর্তিভো ইউরোপা, কাস্তিল থেকে অ্যাটলেটিকো, এবং বাস্ক থেকে রিয়াল সোসিয়েদাদ,  আরেনাস, এবং রিয়াল ইউনিয়ন ছিল অ্যাথলেটিকের সাথে। কিন্তু অ্যাথলেটিক সবার থেকে আলাদা। ১৯৯৪ সালে হোসে মারিয়া আরাতে, যিনি অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি ক্লাবের দর্শন নিয়ে একটি কথা বলে গিয়েছেন যেটি আমি হুবুহু তুলে ধরছি নিচের কিছু লাইনে, 

Athletic Bilbao is more than a football club, it is a feeling – and as such its ways of operating often escape rational analysis. We see ourselves as unique in world football and this defines our identity. We do not say that we are either better or worse than others, merely different. We only wish for the sons of our soil to represent our club, and in so wishing we stand out as a sporting entity, not a business concept. We wish to mould our players into men, not just footballers, and each time that a player from the cantera makes his debut we feel we have realised an objective which is in harmony with the ideologies of our founders and forefathers.

বিলবাও আসলে একটা শহর গড়ে উঠেছে শিল্প আর ফুটবলের উপরে ভিত্তি করে। আমরা ইংল্যান্ডে এর উদাহরণ দেখতে পাই কয়লাখনির শহর নিউক্যাসেল এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের লিভারপুলে। এটা এমনই একটা শহর যেখানে অ্যাটলেটিকোর রিজার্ভ দলের খেলা দেখতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ভিড় জমাবে। এমনকি সবার মধ্যে কেমন একটা তাড়া আছে সপ্তাহের শেষের জন্য, তারপর মাঠে যেতে হবে। এই শহরে ৩৫ হাজার জন দর্শক স্টেডিয়াম ভিড় করেন জাতীয় মহিলা দলের ফাইনাল খেলা দেখতে। স্পেনের শিল্পবিপ্লবে বিলবাও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শহর। শিল্প বিপ্লব সফল করতে এই শহরে পা রেখেছিলেন হাজারে হাজারে ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ। তারই সূত্র ধরে জাহাজ শ্রমিকরা সাউদাম্পটন এবং পোর্টসমাউথ থেকে যারা বিলবাওয়ের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে এসেছিলেন তারা এখানে ফুটবলের সূত্রপাত ঘটান। রাজনীতি গত দিক থেকে বিলবাও একটু  রক্ষনশীল । তাই শুরুর দিকে ইংরেজ শ্রমিকদের নদীর পারে ফুটবল খেলা দেখে একটু অবাক হলেও কিছুদিন পরে আস্তে আস্তে একটা জিমে জন্ম হয় একটি ক্লাবের। সেই জিমেই কিছু অল্পবয়স্ক স্প্যানিশ তরুণ যারা কেমব্রিজ থেকে এসেছিলেন তারা এই শ্রমিকদের সাথে প্রথম খেলাটির সূত্রপাত ঘটান। প্রথম ম্যাচে স্প্যানিশরা হারেন এবং ফিরতি ম্যাচে আবারও তারা পাঁচ গোলেই হেরে যান। 

স্প্যানিশ ফুটবলের ঐতিহ্যের সাথে বিলবাওয়ের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯০২ সালে তারা বিলবাওয়ের অন্য ক্লাবটির সাথে একত্রিত হয়ে ফ্রান্সে খেলতে গিয়েছিলেন এবং সেটি ছিল প্রথম স্প্যানিশ ফুটবল ম্যাচ। সেই ম্যাচে তাদের জয় লাভের কারণে স্পেনে ফুটবলের  রাস্তাটি আরো একটু পরিষ্কার হয় এবং একই সাথে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ফুটবল গতি লাভ করে বাস্কে কান্ট্রিতে। বাস্কের রাজনৈতিক পরিচয় মূলত উগ্র ক্যাথলিক ডানপন্থী। তারই সূত্র ধরে যখন বাস্কের জাতীয় পার্টির জন্ম হয় ১৮৯৪ সালে তখন মাদ্রিদ এর জন্য সেটি একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের প্রথম ২৭ বছর আর বাস্কের রাজনৈতিক দলটি দুটোই একে অপরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেই চলেছে। আজকের রাজনৈতিক ভাবধারার জন্য ফুটবল কেবল একটি সাধারণ খেলা নয় বরং কেন্দ্রের বিরোধিতা করার জন্য একটি অস্ত্র। ৩৪ জন সদস্য নিয়ে ক্লাবটি গঠন করা হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই ক্লাবটি অনেক বড় হয়ে ওঠে এবং কিংস কাপের প্রথম আটটি প্রতিযোগিতার মধ্যে চারটিতে অ্যাথলেটিক জয়লাভ করেন। ফুটবলকে পেশাদার একটি খেলায় পরিণত করার আগ পর্যন্ত সকল ক্লাবই তাদের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে থেকে প্লেয়ারদের কে তাদের দলে নিত। কিন্তু বাস্ক অঞ্চলের এই ক্লাবটি বিগত ১০০ বছরে তারা সবসময়ই তাদের আঞ্চলিক সীমা থেকেই খেলোয়াড় নিয়ে এসেছে এবং রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার সাথে তারাই একমাত্র তৃতীয় ক্লাব যাদের দ্বিতীয় ডিভিশনে পদাবনতি ঘটেনি। 

 একই সাথে এখানে স্টেডিয়ামের কথাটি না বললেই নয়। লা ক্যাথিড্রাল নামে পরিচিত স্টেডিয়ামটি যখন নির্মাণ করা হয়েছিল সেই স্টেডিয়ামের প্রথম খেলাটি খেলা হয়েছিল রিয়াল ইউনিয়ন দলটির সাথে । ১৯০৯ সালের সেই ম্যাচটির কথা বেশিরভাগ মানুষ ভুলে গিয়েছেন কিন্তু সে ম্যাচটিকে স্প্যানিশ ফুটবলের ইতিহাসে অমর করে রাখার ব্যবস্থা করে গিয়েছেন রাফায়েল মরেনো আরেনজাদি। তিনি প্রথম গোলটি করেছিলেন লা ক্যাথিড্রালের মাটিতে। তাঁকে আমরা পিচিচি নামেই চিনি। পিচিচি অমর হয়ে আছেন অরেলিয়া আর্তেতার চিত্রের মাধ্যমে। এই চিত্রকর্মে যেই মহিলাকে দেখা যাচ্ছেন তার তাকেই পিচিচি পরবর্তীকালে বিয়ে করেন। ১৯২১ সালের অষ্টম বার কোপা দেল রে জেতার পরে পিচিচি তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ ঘোষণা করেন এবং একবছর পরেই তিনি মারা যান। কিন্তু স্প্যানিশ ফুটবল এর সাথে জড়িত কর্মী-খেলোয়াড় এবং সকল ফুটবল ভক্তরাও তার কথা সব সময় মনে রাখবেন। ১৯২৬  সালে তার একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় সান মানে স্টেডিয়ামে, তারপর থেকেই সকল ক্লাব যারা প্রথমবার সান মামেস  স্টেডিয়ামে খেলতে আসেন,  তাদের ক্যাপ্টেন অথবা প্রেসিডেন্ট ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে পিচিচির মুর্তিতে একতোড়া ফুল দিয়ে তার স্মৃতির প্রতি সম্মান করেন। 

Aurelio Arteta, Idyll in the sports fields, Bilbao, Althletic Club de Bilbao [from artefootball.com]
ফুটবলের সাথে চারু ও কারুকলার যে সম্পর্ক সেটা আমরা অ্যাথলেটিক ক্লাবটির চিত্রকর্মগুলোর দিকে তাকালেই জানতে পারি। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন বিলবাও কোপা দেল রে বারবার জিতছে,  এরমধ্যে ১৯১৪-১৬ সালে পরপর তিনবার জেতার জন্যই তারা আদি কাপটির মালিকানা লাভ করেন। তাদের এই বিজয় প্রতিবারই মাদ্রিদ এর রাজনৈতিক কেন্দ্রের প্রতি জবাব ছিল এজন্যই তাদের এ বিষয়গুলোকে মহোৎসবে পরিণত করা হতো। সেই দিনগুলোকে অমর করে রাখার জন্যই হোসে আরুয়ে,  অরেলিয়া আর্তেতা প্রমূখ চিত্রশিল্পী বেশকিছু ছবি আঁকেন। এই ছবিগুলো এখন পরিণত হয়েছে স্প্যানিশ ফুটবলের ঐতিহ্যে । এখানে আরো একটি চিত্রের কথা না বললেই নয়। ১৯১৫ সালে অ্যাথলেটিক ক্লাব এর প্লেয়ারদের একটি চিত্র আঁকার দায়িত্ব দেয়া হয় হোসে আরুয়েকে,  যেখানে সকল প্লেয়াররা দাঁড়িয়ে ছিলেন সান মামের গোলপোস্টের সামনে। শতাব্দীর শুরুর দিককার স্প্যানিশ চিত্রকলা বোঝার জন্য এই ছবিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তৎকালীন ইংরেজ ফ্রেন্ডস এবং ইতালি ও শিল্পের সাথে স্প্যানিশ শিল্পীদের পার্থক্য এখানে পরিষ্কার বোঝা যায় তারা কি করে তাদের খেলোয়াড়দের কে ছবিতে একই ফ্রেমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। পরিশেষে এখানেই বিলবাও ক্লাবটির আদি জার্সিটি প্রথমবার চোখে পড়ে, সাদার মধ্যে লাল স্ট্রাইপ। এবং এভাবেই অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সাথে স্প্যানিশ ফুটবলের ঐতিহ্য , বাস্ক অঞ্চলের শিল্প, রাজনীতি এবং গনমানুষের জীবনধারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল।

Jose Arrue, Athletic Club Team, 1915, Bilbao, Athletic Club de Bilbao, – source Artefootball

Sources –

a. Morbo – A Story of Spanish Football

b. Artefootball

Cover image from Wikimedia commons.

You May Also Like